Print Date & Time : 26 August 2025 Tuesday 4:09 pm

ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন সমীকরণ

 

আল আমিন হোসাইন : শিল্প বিপ্লবের পর থেকে যতই সময় অতিবাহিত হয়, ততই অস্ত্র আর বোমার বিধ্বংসী শক্তিকে পরাস্ত করে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয় ব্যবসা-বাণিজ্য। সেই জন্য সামরিক যুদ্ধে না জড়িয়ে শত্রুরাষ্ট্রকে শায়েস্তা করার অন্যতম কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে বাণিজ্যযুদ্ধ। যেখানে একটি দেশ আরেকটি দেশের ক্ষতি করতে পণ্যের ওপর বিভিন্ন শুল্ক আরোপ ও কোটা সীমাবদ্ধতা প্রয়োগ করে। ফলে একসময় শুরু হয় রাজনৈতিক টানাপোড়ন। ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক বিশ্বকে বাণিজ্যযুদ্ধের দিকেও ঠেলে দিয়েছে। এই শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও মন্দা পরিস্থিতি তৈরি করছে। ট্রাম্প যখনই শুল্ক নিয়ে কিছু বলেছেন বা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন, তাৎক্ষণিকভাবে মার্কিন শেয়ারবাজারে তার প্রভাব পড়েছে। শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে। ইতোমধ্যে ট্রাম্প সরকার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর শুল্ক আরোপ করেছে নিম্নোক্ত অনুসারে, ভারত-৫০ শতাংশ, পাকিস্তান-১৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা-২০ শতাংশ, আফগানিস্তান- ১৫ শতাংশ, বাংলাদেশ- ২০ শতাংশ। এই দেশগুলোর ওপর শুল্কের প্রভাব ও কূটনৈতিক বিষয়গুলো আলোচনা করা হলো:

বাংলাদেশ: ট্রাম্পের শুল্ক হার ৩৭ শতাংশ থেকে নামিয়ে ২০ শতাংশ আনতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। এটি দেখায় যে বাংলাদেশের কূটনৈতিক আলোচনা- শক্তি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। একইসঙ্গে এটি আমেরিকাকে বার্তা দিয়েছে যে ঢাকা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজার পক্ষে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এ সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে আরও বাণিজ্যিক সুবিধা পুনরুদ্ধারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির সিংহভাগই পোশাক পণ্য। ফলে নতুন এই শুল্ক কাঠামোর অধীনে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। তবে বেশ কিছু কারণে বাংলাদেশ এখনও এ বিষয়ে আশাবাদী থাকতে পারে। শুল্ক চাপানো হলেও, আমেরিকা পুরোপুরি সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইবে না, কারণ নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক ভারসাম্যে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ (চীন-ভারত-পাকিস্তান) অবস্থান। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশকে এখন আমেরিকার পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশাধিকারের ওপর বেশি জোর দিতে হবে।

আফগানিস্তান: ট্রাম্প সরকার দেশটির ওপর ১৫ শতাংশ শুরু আরোপ করেছে। আফগানিস্তান দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। শুল্ক আরোপ অর্থনৈতিকভাবে বড় আঘাত না আনলেও, প্রতীকীভাবে এটি মার্কিন আস্থা ও সমর্থনের হ্রাস নির্দেশ করে। দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার বাণিজ্যিক করিডোরে (পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান) শুল্ক সংকট একটি ভূরাজনৈতিক সুযোগ তৈরি করবে, যেখানে চীন ও রাশিয়া আরও প্রভাবশালী হবে। ধারনা করা যায়, ট্রাম্পের শুল্কনীতি আফগানিস্তানের জন্য অর্থনৈতিক চাপের তুলনায় প্রতীকী বার্তা বেশি বহন করবে।

শ্রীলঙ্কা: দক্ষিণ এশিয়ায় ট্রাম্পের ট্যারিফের শিকার আরেক দেশ শ্রীলঙ্কা। দেশটির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার তৈরি পোশাকের প্রায় ৪০ শতাংশই রপ্তানি করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। তৈরি পোশাকশিল্প দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। নারীদের অংশগ্রহণ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে সাহায্য করেছে। উচ্চ শুল্কের হুমকি শ্রীলঙ্কাকে বাণিজ্য আলোচনা টেবিলে নিয়ে এসেছে। এতে আমেরিকার বাজারে শ্রীলঙ্কার সস্তা পোশাক, চা বা রাবার প্রবেশ কমবে। ফলে মার্কিন দেশীয় উৎপাদকরা প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পাবেন।

পাকিস্তান: দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানে ১৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। কম শুল্ক আরোপের কারণে পাকিস্তানের বস্ত্রশিল্প খাত সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

পাকিস্তানের মোট রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশই এই খাত থেকে হয়ে থাকে। আর এই রপ্তানির একটা বড় অংশই যুক্তরাষ্ট্রে যায়। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। এমনকি পাকিস্তান গত জুনে ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়নও দেয়। অন্যদিকে চীন, পাকিস্তানকে ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ বলে সম্বোধন করেছেন যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে। এতে পাকিস্তান, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সামরিক দৃঢ় সম্পর্ক প্রতিস্থাপন করেছে।

ভারত: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ভারতে। রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র কেনার জন্য ভারতের ওপর ‘অনির্দিষ্ট শাস্তিমূলক পদক্ষেপ’ এটি। যার পরিমাণ ২৫ শতাংশ থেকে বর্তমানে ৫০ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। ট্রাম্প চান, মার্কিন কৃষিপণ্য যেন অবাধে ভারতীয় বাজারে অবাধে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু ভারতের কৃষকরা সেই ধাক্কা নিতে পারবেন না বলেই ভারত রাজি হচ্ছে না। ফলে ভারত সরকার এর প্রতি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। কারণ তারা তাদের দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করার জন্য এ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। ফলে সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে যে ভারত ওয়েস্টার্ন ব্লক থেকে বেরিয়ে এসে ইস্টার্ন ব্লকের দিকে আগ্রহ বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে ভারত BBRICS-এর সদস্য হওয়ায় ট্রাম্প ভারতের এই নীতিকে কোনোভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। যেমন- এতদিন ধরে ভারত এবং আমেরিকার যে বন্ধুত্ব সুলভ সম্পর্ক ছিল এখন তা তলানিতে পৌঁছেছে। ফলে ভারত, রাশিয়া-চীন এসব দেশের সঙ্গে কূটনীতিক বন্ধুত্বের চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদিও ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক তেমন ভালো না। অন্যদিকে বড় বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত শুল্কের কারনে ভারত থেকে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে।

বিনিয়োগকারীরা দক্ষিণ এশিয়ার কম শুল্কের দেশের দিকে ঝুঁকতে পারেন, যেমন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য ও লাতিন আমেরিকার মতো বাজারেও নতুন গ্রাহক খুঁজছে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

ভুটান, মালদ্বীপ ও নেপাল: যেসব দেশ Annex-I তালিকায় নেই, অর্থাৎ উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশ, তাদের ক্ষেত্রে পুরোনো নিয়মানুযায়ী ১০ শতাংশ বেসলাইন শুল্কহার প্রযোজ্য থাকবে। অর্থাৎ, ভুটান, মালদ্বীপ ও নেপাল যদি কোনো নতুন চুক্তিতে না আসে, তাহলে তাদের ওপর ১০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপিত হবে।

বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাই প্রায় সব দেশকেই আমদানি ও রপ্তানি করতে হয়। যে কারণে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের নির্ভরতা রয়েছে। বাণিজ্য যুদ্ধে যেহেতু পণ্যের দাম বেড়ে যায় তাই শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষরাই, যারা পণ্য ক্রয় করে।

বিদেশি পণ্যে শুল্ক বসানোর জেরে সেগুলোর দাম বেড়ে যাবে মার্কিন বাজারে। এর জেরে আমদানি কমিয়ে দেশটির অভ্যন্তরে দেশি পণ্যের উৎপাদনের চেষ্টা চলবে। ট্রাম্পের শুল্কনীতি স্বল্পমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রকে লাভ দিলেও, দীর্ঘমেয়াদে তা রাজনৈতিক সম্পর্ক খারাপ করে এবং উভয় দেশের ভোক্তা-উৎপাদক উভয়ের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়