Print Date & Time : 17 November 2025 Monday 5:04 am

ডিজিটাল রূপান্তরে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকা

ইমদাদ ইসলাম : কুড়িগ্রাম জেলার রাজিবপুর উপজেলার চর এলাকা কোদালকাটি ইউনিয়নের নতুন পাড়াগ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে নূর জাহান শিমুল এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েই ঢাকার একটি অনলাইন আইটি প্রতিষ্ঠান থেকে ছয় মাসের গ্রাফিক ডিজাইনের ওপর একটি কোর্স করে। শিমুলদের এলাকার অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র। আইটি প্রতিষ্ঠানে কোর্স করার সময় সহপাঠী হিসেবে পরিচয় হয় সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার কাদাকাটি গ্রামের ইতু মণ্ডলের সঙ্গে। ইতু ও শিমুলের মতো এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েই কোর্সটিতে ভর্তি হয়েছে। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা কাদাকাটি গ্রামের অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র। সুপেয় পানির অভাব, কাজের অভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এখানকার মানুষের অভাব শেষ হতে চায় না। দেশের দুই প্রান্তের পশ্চাৎপদ দারিদ্র্যপীড়িত এলাকার দুই মেয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও নিজেকে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ঘরে বসেই রিমোট হায়ারিং করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বায়ারদের চাহিদামতো কাজ করে ভালোই আয় করছে। পরিবারের দারিদ্র্য দূর করার পাশাপাশি গ্রামের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের আইটি প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করে তাদেরও আয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।

সারা পৃথিবীতে প্রযুক্তিগত রূপান্তর ও ডিজিটাল শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীরা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, তাদের অবদানের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠা এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীর অভিগম্যতা নিশ্চিতকরণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশে ৮৬ হাজারেরও অধিক গ্রাম রয়েছে। এখনও দেশের বেশিরভাগ জনগণই গ্রামে বসবাস করে। জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি নারী। আবার এ অর্ধেক নারীর সিংহভাগই বসবাস করে গ্রামে। আমাদের গ্রাম বলতে চোখের সামনে চিরাচরিতভাবে ফুটে ওঠা অজ পাড়াগাঁ এখন আর খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। শহরের ছোঁয়া লেগেছে গ্রামগুলোয়। বিদ্যুৎ সুবিধা এখন সব গ্রামেই আছে। একসময় যোগাযোগব্যবস্থা বলতে ছিল গরুর গাড়ি আর নৌকা। এখন সেই গরুর গাড়ি আর নৌকা দেখতে হলে যেতে হবে জাদুঘরে।

বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের গ্রামীণ অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে, যার সিংহভাগ অবদান নারীর। গ্রামীণ নারীরা এখনও উচ্চশিক্ষা বা সুশিক্ষা থেকে কিছুটা হলেও পিছিয়ে আছে। তারপরও নিজেদের অদম্য ইচ্ছা, সরকারি-বেসরকারি যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। গ্রামীণ নারীরা কুটিরশিল্প, বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ, সেলাইসহ নানা ধরনের কাজে যুক্ত থাকলেও এখন অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। গ্রামীণ নারীরা এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে বেশি মনোযোগী। সংসারের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার পর ঘরে বসে রিমোট হায়ারিং করছে। ডিজিটাল রূপান্তরে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকা বহুমুখী। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের ডিজিটাল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলছে এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত হচ্ছে। শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকারের মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন বাজার এবং কৃষি-সম্পর্কিত তথ্যের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিতেও তারা পিছিয়ে নেই। তারা বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার পাশাপাশি ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

গ্রামীণ নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির জ্ঞান এবং ব্যবহারের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে সমতা আনার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি নারীর ব্যবহার উপযোগী প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ব্যাবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়নসহ—সব ক্ষেত্রেই তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং সব ক্ষেত্রে নারীর সমান প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতকরণে অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য কার্যকর এবং টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সেই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তিসহ সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সম-অংশগ্রহণ এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নারীর প্রতিবন্ধকতা এবং সীমাবদ্ধতাগুলো প্রতিনিয়ত চিহ্নিত করে সেগুলো দ্রুত সমাধানের পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০৩০ সাল নাগাদ নারী-পুরুষের সমান অংশীদারত্ব নিশ্চিত করার জন্য গ্রাম ও শহরকে সমান গুরুত্ব দিয়ে ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

১৯৭৪ সালে শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ২ দশমিক ৬ শতাংশ, ১৯৯০ সালে ১৪ শতাংশ এবং ২০১০ সালে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৩৬ শতাংশ। ২০২২ সালে নারীর অংশগ্রহণ ছিল কম-বেশি ৪৩ শতাংশ। বাংলাদেশের জিডিপিতে নারীর অবদান কম-বেশি ২০ শতাংশ। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে এবং এতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় নারীরা তাদের দক্ষতা প্রমাণ করছে এবং কর্মক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে। সামাজিক স্বীকৃতিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া নারীপ্রধান পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা নারীদের আরও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার লক্ষণ। এর ফলে নারীরা এখন পরিবারের সীমানা পার হয়ে সমাজ ও দেশের উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালন করার সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের কমবেশি ৭৭ শতাংশ গ্রামে বাস করে। নারীরা শুধু কৃষিশ্রমিক হিসেবে নয়, বিভিন্ন কৃষিপ্রযুক্তি গ্রহণ ও কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। যদিও তাদের কাজ এখনও যথাযথভাবে স্বীকৃত হয়নি, তবুও তাদের অবদান দেশের কৃষি খাতকে শক্তিশালী ও উন্নত করছে।

দেশের কৃষি এবং কৃষি-সম্বন্ধীয় ব্যাবসা-বাণিজ্য এবং ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে আধুনিকতার ছাপ পড়েছে। হস্তশিল্প, বয়নশিল্প, খাদি ও গ্রামীণ উদ্যোগের প্রভাব আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়া মৎস্য চাষ, ফুল চাষ, পাট চাষ, পান চাষ, পশুপালন, দুগ্ধ প্রকল্প, ইক্ষু চাষ এবং সেইসঙ্গে চা-শিল্প ও কাগজশিল্পও আশার আলো দেখাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে স্বনির্ভরতা দিয়ে আমাদের উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে। শিক্ষা পদ্ধতিকে সে ধরনের কর্মমুখী করার উদ্দেশ্যে সরকার ইতোমধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পাহাড়ি জুম চাষ আমাদের অর্থনীতিতে যথেষ্ট সমাদৃত। এসব ক্ষেত্রে তাদেরও উন্নত চিন্তাধারা এবং সহযোগিতার প্রয়োজন। বনজ সম্পদের অবাধ ধ্বংস রোধ করে জুমচাষির চাষ ক্ষেত্রকে উন্নত প্রকল্পের আওতায় আনতে সরকারি সহযোগিতা রয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান চিরন্তন। আমরা বাংলাদেশি নারীকে ঘরের লক্ষ্মী বলে জানি। বাস্তবে নারী দূরদর্শী ও অধ্যবসায়ী, আদর্শ সমাজ গঠনের অগ্রদূত। গ্রামীণ অর্থনীতিতে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া লেগেছে। এক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। কৃষিক্ষেত্রে এখন অনেক শিক্ষিত মহিলা ও তরুণীর প্রত্যক্ষ অবদান চোখে পড়ার মতো। তারাই মাঠে বর্ষাকালীন শস্য থেকে রবিশস্য উৎপাদনের সময় পর্যন্ত নিরলস পরিশ্রম করছে। গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের সিংহভাগই মহিলাকেন্দ্রিক ও মহিলানির্ভর। অনেক ক্ষেত্রেই গ্রাম-শহর নির্বিশেষে মহিলাদের শ্রমবিমুখতাও দেখা গেলেও কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্পে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত নারীরা চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেরাই এখন উদ্যোক্তা হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি তাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছে।

একসময় নারীদের শিক্ষার সুযোগ সীমিত ছিল। তবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সেই বাধাকে দূর করে দিয়েছে। বিভিন্ন ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নারীরা ঘরে বসেই নতুন দক্ষতা শিখতে পারছেন। অনেক নারী অনলাইন কোর্স করে সফ্‌টওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং গ্রাফিক ডিজাইন শিখছেন। উদ্যোক্তা হাওয়ার প্রতি নারীদের আগ্রহ বাড়ছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম শুধু ব্যাবসা বা চাকরির জন্য নয়, এটি নারীদের সামাজিক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়েছে। ডিজিটাল রূপান্তরে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর সুফল পাচ্ছে দেশের জনগণ। নারী সচেতনতা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি নারীর কর্মসংস্থানসহ অর্থনৈতিতকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। গ্রামীণ নারীরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নতুন ব্যাবসা শুরু করছে এবং সফলও হচ্ছে। আমাদের গ্রামীণ অর্থনৈতিক তাগিদে নারীদের আরও সক্রিয় হতে হবে এবং তাদের প্রতি সমাজ ও সরকারের পক্ষ থেকেও প্রয়োজনীয় আরও সহায়তা দান করতে হবে। তাদের প্রেরণায় সমাজের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর নারীরা আরও তৎপর হয়ে উঠবেন, এটাই প্রত্যাশা।

পিআইডি নিবন্ধ