নিজস্ব প্রতিবেদক : ভয়ংকর রূপ নিয়েছে ক্ষুদ্র প্রাণী এডিস মশাবাহী রোগ ডেঙ্গু। দেশে গতকাল রোববার সকাল ৮টা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৭৮ জন। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে প্রাণ গেল ৩৬৪ জনের। আর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯০ হাজার ২৬৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল এসব তথ্য জানানো হয়।
অধিদপ্তর জানায়, সর্বশেষ মৃত্যুর মধ্যে তিনজন মারা গেছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বাকি রোগীদের মধ্যে একজন করে মারা গেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নরসিংদী সদর হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পার্কভিউ হাসপাতাল লিমিটেডে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত এক দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৭৭৮ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৮৩ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩৪ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১২১ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১২৯ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৮১ জন, খুলনা বিভাগে ১১২ জন (সিটি করপোরেশনের বাইরে), ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৪ জন, রাজশাহী বিভাগে ৪৮ জন, রংপুর বিভাগে ১৯ জন ও সিলেট বিভাগে সাতজন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এদিকে গত এক দিনে সারা দেশে এক হাজার ১১১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৮৭ হাজার ৪৪২ জন।
প্রতিদিনই বাড়ছে সংক্রমণÑবাড়ছে আতঙ্কও। হাসপাতালগুলোয় কান্নার রোল থামছেই না। বিশেষজ্ঞরা আগেই সতর্ক করেছিলেন যে নভেম্বরেও ডেঙ্গুর দাপট অব্যাহত থাকবে। কিন্তু আগাম ব্যবস্থাপনায় যথাযথ তৎপরতা না থাকায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে। চলতি নভেম্বরের এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৮৩ জন, যেখানে গত মাসে মৃত্যু ছিল ৮০ জন।
ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসে। বিশেষ করে মার্চ মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগ বিস্তারের সময় হিসেবে ধরা হয়। আর পিক টাইম হিসেবে বিবেচনা করা হয় আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়কে। অর্থাৎ এই সময়টাকেই ডেঙ্গু বিস্তারের সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসেবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে থাকেন। কিন্তু চিত্র ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে। অক্টোবরের পরে ডেঙ্গু যেন আরও ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত তিন মাসে প্রতি মাসে রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে গড়ে দেড়গুণ হারে। হিসাব অনুযায়ী ডেঙ্গুর মৌসুম প্রায় শেষ হলেও সংক্রমণ কমেনি। এখনও প্রতিদিন ৫০০ থেকে এক হাজার রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন গড়ে তিন-চারজন।
বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ঢাকার বাইরে বিশেষ করে বরিশাল বিভাগে রোগীর সংখ্যা বেশি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মৃত্যু সর্বোচ্চ।
দেশের খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘একসময় ডেঙ্গুকে বর্ষার রোগ ভাবা হলেও এখন সারা বছরই রোগী পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এ রোগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো বড় উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। শহর থেকে গ্রামে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। মৃত্যুও বাড়ছে। প্রশাসনের উদাসীনতা যেমন আছে, তেমনি জনগণের মধ্যেও সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। ঘর থেকেই সচেতনতা শুরু করতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গণটিকা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তা এখনও আসেনি।’
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটÑআইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় প্রশাসনÑকেউই মৃত্যু ঠেকাতে পারছে না। অথচ মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। ডেঙ্গুকে এখন জরুরি পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এটিকে মৌসুমি রোগ ভেবে দেখার সুযোগ নেই। আগাম সতর্কতা, ভেক্টর কন্ট্রোল এবং কমিউনিটি অ্যাকশন ছাড়া ডেঙ্গু থামানো যাবে না। জনগণকেও দায়িত্ব নিতে হবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘এবার নভেম্বরেও ডেঙ্গুর দাপট চলছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর মশার ঘনত্ব বেশি। রোগীও বেশি।’
তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ ঝুঁকির সময়। তিনি বলেন, ‘এডিস মশার ব্রিডিং সোর্স ধ্বংস করা এখন সবচেয়ে জরুরি। যেখানে জনবলের ঘাটতি আছে, তা পূরণ করে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। মানুষকে বাড়ি ও আঙিনায় পানি জমতে না দেয়ার বিষয়ে সচেতন করতে হবে। সিটি করপোরেশনগুলো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের কাজ হলো হটস্পট ম্যানেজমেন্ট ও লার্ভা ধ্বংস করা, কিন্তু তা তেমনভাবে হচ্ছে না।’
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ৫৭৫ জন। এর আগে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয় এবং ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন মোট তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।
প্রিন্ট করুন











Discussion about this post