নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবিলায় নেওয়া হয়নি কার্যকর ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ২০ হাজার ৭০২ জন। গত বছরের একই সময়ে আক্রান্ত হয় ৬ হাজার ৩২০ জন। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৮১ জনের। গত বছরের একই সময়ে মৃত্যু হয় ৫৬ জনের। অর্থাৎ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার আক্রান্তের সংখ্যা তিনগুণের বেশি। মৃতের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ।
স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, দ্রুত একটি সমন্বিত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ না করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। নগর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, পানি নিষ্কাশনের অভাব ও জনগণের সচেতনতার ঘাটতি এই সংকটকে ঘনীভূত করছে। বর্তমানে আক্রান্তদের বড় অংশই ঢাকার বাইরের, এমনকি অনেক জেলা শহরে সংক্রমণের হার ঢাকার তুলনায় বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও স্বাস্থ্য খাতের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো ডেঙ্গুর চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। মাঠপর্যায়ে নেই কোনো সমন্বিত রোডম্যাপ, নেই জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার তৎপরতা। অন্যদিকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন, ট্রেইনি চিকিৎসক বা ডিপ্লোমা নার্সদের আন্দোলনের মতো বিষয়গুলো নিয়ে সরকারকে বেশি মনোযোগ দিতে দেখা গেছে। এগুলো নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনসহ ব্যাপক তড়িঘড়ি করা হয়। অথচ ডেঙ্গু ও মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির মতো সংকটকালীন স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমে নজর নেই বললেই চলে। সরকার যেন এসব নিয়ে তেমন মাথাই ঘামাচ্ছে না। ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ খাতের উন্নয়নে আসলে কী করছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এবার ডেঙ্গুর ধরন কিছুটা ভিন্ন। জ্বরের ধরন জটিল ও প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাওয়ারও ঝুঁকি বেশি। অধিকাংশ জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ড না থাকায় রোগীরা ঢাকামুখী হচ্ছেন, ফলে রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় চাপ বাড়ছে।
ইবনে সিনা হাসপাতালের আরএমও এবং ক্লিনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ডা. তামিম আল মিশু বলেন, ‘এবার ডেঙ্গুর ভ্যারিয়েন্ট একটু আলাদা। অনেক রোগীর প্রাথমিক উপসর্গ দেখে ডেঙ্গু শনাক্ত সম্ভব হচ্ছে না। সংক্রমণ রোধে রোগীকে ১০ দিনের জন্য আইসোলেশনে রেখে বাসায় চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঈদ বা ছুটিতে ঢাকাসহ বড় শহর থেকে মানুষ গ্রামে যাওয়ার কারণে অনেকেই ভাইরাস বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন। গ্রামের অনেক মানুষ ডেঙ্গুর বিষয়ে সচেতন না হওয়ায় দেরিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অধিকাংশ গ্রামীণ হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থাও নেই।’
এদিকে মশক নিধনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর উদ্যোগ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেক এলাকায় সপ্তাহের পর সপ্তাহ স্প্রে দেওয়া হয়নি, কোথাও কীটনাশক নেই, আবার কোথাও জনবল সংকটে অভিযান থেমে আছে। ঢাকায় সীমিত পরিসরে ফগিং হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৬১ এবং মৃত্যু হয় ১০ জনের। ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন আক্রান্ত হয়, মৃত্যু হয় তিনজনের। মার্চে ৩৩৬ জন আক্রান্ত হলেও কারও মৃত্যু হয়নি। এপ্রিল ও মে মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৭০১ ও ১ হাজার ৭৭৩; মৃত্যু হয় যথাক্রমে সাতজন ও তিনজনের। জুনে আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৯৫১ জনের, মৃত্যু হয় ১৯ জনের। জুলাইয়ে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেড়ে ১০ হাজার ৪০৬ জনে পৌঁছে, মৃত্যু হয় ৩৯ জনের। চলতি বছর ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ৬০টি জেলায়। এবার শিশুমৃত্যুর হারও উদ্বেগজনক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। এর মধ্যে ভেক্টর কন্ট্রোলের কার্যকর ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত কীটনাশক সরবরাহ, নিয়মিত স্প্রে কার্যক্রম, হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি নিশ্চিত করা এবং সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ থাকা জরুরি।
রাজধানীর মুগদা এলাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত এক রোগীর স্বজন বলেন, সরকারের উচিত ডেঙ্গু ও করোনার মতো প্রাণঘাতী সংকটের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া। সচেতনতা বাড়িয়ে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে মৃত্যু হার কমাতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। অনেকে বলছেন, প্রতি বছরই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বড় অঙ্কের বিদেশি ঋণ-অনুদান পেয়ে থাকে। কিন্তু জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালসহ দেশের স্বাস্থ্য খাতের কোনো উন্নতি চোখে পড়ে না। এমন বাস্তবতায় জনমনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছেÑএই অর্থ আসলে কোথায় ব্যয় করা হচ্ছে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার আগেই হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ গুলোয় অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানো, পর্যাপ্ত চিকিৎসক, ডেঙ্গু ইউনিট, ওষুধ ও সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা, ডেঙ্গু পরীক্ষায় মানসম্মত কীট সরবরাহ নিশ্চিত করা, চিকিৎসা ব্যবস্থার মনিটরিং জোরদার এবং জনসচেতনতা বাড়াতে দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

Discussion about this post