মনিরুল হক ও নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) জনপ্রিয় শিশু-কিশোরদের প্রতিযোগিতা ‘নতুন কুঁড়ি’ দীর্ঘ বিরতির পর আবার শুরু হয়েছে। ১৯ বছর আগে অনুষ্ঠানটি শেষ হওয়ার পর থেকে দর্শকরা এর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় ছিলেন। এবার সেই অপেক্ষার অবসান ঘটছে।
১৯৭৬ সালে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মোস্তফা মনোয়ারের উদ্যোগে যাত্রা শুরু হয় নতুন কুঁড়ির। গান, নৃত্য, আবৃত্তি, অভিনয় ও উপস্থাপনাসহ নানা বিষয়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অগণিত প্রতিভা ওঠে এসেছে এই মঞ্চ থেকে। তারানা হালিম, রুমানা রশিদ ঈশিতা, তমালিকা কর্মকার, জাকিয়া বারী মম, তারিন জাহান, সামিনা চৌধুরীসহ অসংখ্য শিল্পী আজও দর্শকদের মনে দাগ কেটে আছেন এই অনুষ্ঠান থেকে ওঠে এসে।
২০০৬ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি নিয়মিত প্রচারিত হলেও পরবর্তী সময়ে আর আয়োজন করেনি বিটিভি। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবার নতুন কুঁড়ি ফিরছে নতুন আঙ্গিকে। শিশু-কিশোরদের প্রতিভা বিকাশ ও জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি দেয়ার লক্ষ্যেই আবারও প্রতিযোগিতাটি চালু করা হচ্ছে। এবারের আয়োজনের জন্য দেশকে ১৯টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে, যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরাও সুযোগ পায়।
তবে আলোচনায় রয়েছে আরেকটি প্রশ্ন কেন নতুন কুঁড়ি থেকে ওঠে আসা শিল্পীরা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লাইম লাইটে থাকতে পারেননি?
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অভিজ্ঞজনদের মতে, এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, গত দেড় দশকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনেকাংশে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন হয়ে পড়েছিল। যেসব শিল্পী রাজনৈতিক মঞ্চ বা সরকারপন্থি কর্মসূচির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাদের প্রচার-প্রসার ঘটেছে বেশি। অন্যদিকে নিরপেক্ষ বা ভিন্ন ধারার শিল্পীরা তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে ছিলেন।
দ্বিতীয়ত, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও গণমাধ্যমে প্রচারের ক্ষেত্রেও একটি সীমিত গোষ্ঠী প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে প্রতিভাবান হয়েও অনেক নতুন কুঁড়ি শিল্পী বড় পরিসরে নিজেদের প্রকাশ করতে পারেননি। এছাড়া নীতিগত পরিবর্তন ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট নীতির কারণে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন।
বাংলা গানের জগতে অন্যতম জনপ্রিয় গীতিকার ও সুরকার ইথুন বাবু শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নতুন কুঁড়ি শুধু একটা প্রতিযোগিতা নয়Ñ এটা আমাদের সংস্কৃতির মেরুদণ্ডকে নতুন করে জাগিয়ে তোলার এক অসাধারণ উদ্যোগ। নতুন কুঁড়ি বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে প্রতিভা খুঁজে বের করার একটা সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। এখান থেকেই আগামী দিনের গায়ক, অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের উত্থান ঘটবেÑ যারা দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে আরও উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই মঞ্চে অংশ নেয়া বাচ্চাদের চোখে যে স্বপ্ন দেখি, তা সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। তারা শুধু গান বা অভিনয় শিখছে নাÑ তারা শিখছে আত্মবিশ্বাস, শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেম। এ ধরনের কর্মসূচি তরুণ প্রজš§কে সৃজনশীল পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। ভবিষ্যতে যখন আমরা নতুন মুখগুলোর সাফল্যের গল্প শুনব, তখন গর্বের সঙ্গে বলবÑ হ্যাঁ, ওরা এসেছে নতুন কুঁড়ি থেকে।’
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবার আশ্বাস দিয়েছে, নতুন কুঁড়ির বিচার ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনো পক্ষপাত থাকবে না। মেধা ও যোগ্যতাই হবে মূল ভিত্তি।
সাংস্কৃতিক কর্মীরা বলছেন, যদি সত্যিই নিরপেক্ষভাবে আয়োজন করা যায়, তবে নতুন কুঁড়ি আবারও হয়ে উঠবে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা। এটি শুধু শিশুদের মঞ্চই নয়, বরং ভবিষ্যতের তারকা তৈরির এক অনন্য আয়োজন।
অভিনয়, আবৃত্তি, গল্পবলা/কৌতুক, সাধারণ নৃত্য/উচ্চাঙ্গ নৃত্য, দেশাত্মবোধক গান/ আধুনিক গান, রবীন্দ সংগীত, নজরুলসংগীত, লোকসংগীত ও হামদ-নাত এই ৯টি বিষয়ে ‘ক’ ও ‘খ’ শাখায় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। ‘ক’ শাখার প্রতিযোগীদের (ছেলে-মেয়ে) বয়সসীমা ৬ থেকে ১১ এর নিম্নে এবং ‘খ’ শাখার ক্ষেত্রে ১১ থেকে ১৫ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন কুঁড়ির ফাইনাল প্রতিযোগিতা ২ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে।
শিশু-কিশোরদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় উৎসাহিত করতে ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রতিযোগিতাটি পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
‘নতুন কুঁড়ি’র হাত ধরে দেশের মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন অনেক শিল্পী। অনুষ্ঠানটি শুধু শিশু-কিশোরদের অনুপ্রাণিত করেনি বরং দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বহু তারকার জš§ দিয়েছে।
গত ১৭ আগস্ট তথ্য ও সম্প্র্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম বিটিভি প্রাঙ্গণে শিশু-কিশোরদের প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা ‘নতুন কুঁড়ি-২০২৫’-এর উদ্বোধন করেন।
প্রিন্ট করুন










Discussion about this post