মীর আনিস : বিপ্লবে হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গেছে দেশের ব্যাংক খাত। লুটেরাদের হাত থেকে পুরোনো মালিকদের হাতে ফিরে এসেছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক। এর মধ্যে অন্যতম ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি)। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুমায়ুন জহির পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ফিরে এসেছে ব্যাংকটি। এর মধ্য দিয়ে ব্যাংকটির অস্তিত্ব রক্ষা পেল। হুমায়ুন জহিরের ছেলে শরীফ জহীরের নেতৃত্বে অল্প সময়ে ইউসিবির হারানো সুনাম পুনরুদ্ধার হয়। পাশাপাশি ব্যাংকটিতে ফিরে আসে সুশাসন। ইউসিবির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
আরও জানা গেছে, দক্ষ, অভিজ্ঞ, সৎ ও যোগ্য চেয়ারম্যান পেয়ে খুশি ইউসিবির সব কর্মকর্তা। তারা মনে করছেন, চেয়ারম্যানের আলোয় এখন ইউসিবি আলোকিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ডিং যে সংকট ছিল তা দূর হয়ে গেছে। এখন কেবল ঘুরে দাঁড়ানোর অপেক্ষা।
এ ব্যাপারে ইউসিবির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নেপোলিয়নের পছন্দের উক্তি উল্লেখ করে বলেন, ‘আন্ডার অ্যা গুড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, দ্য নাইল গেইনস অন দ্য ডিজার্ট। আন্ডার অ্যা ব্যাড ওয়ান, দ্য ডিজার্ট গেইনস অন দ্য নাইল।’ শরীফ জহীরের সুব্যবস্থাপনায় সব কিছু ম্যাজিকের মতো কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, যেখানে অব্যবস্থাপনা থাকে, সেখানে সঠিক ব্যবস্থাপনায় দ্রুত ভালো ফল পাওয়া যায়। ব্যাংকের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমানতকারীদের আস্থা। ইউসিবিতে সেটি ফিরে এসেছে। তবে ক্ষত সারিয়ে তুলতে সময় লাগবে।’
জানা গেছে, বহু কলঙ্কের সাক্ষী ইউসিবি। আর এই কলঙ্কের জš§দাতা চট্টগ্রামের এক রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক পরিবার। তিনি হলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। চৌধুরী পরিবারের অপেশাদারি ও অনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে বারবার ইউসিবি আলোচনায় এসেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা, ইমেজ। জীবন দিতে হয়েছে ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান হুমায়ুন জহিরকে। আর পাপের ফল হিসেবে ব্যবসায়ী সমাজ ও সারাদেশে ঘৃণীত হয়েছে চট্টগ্রামের চৌধুরী পরিবার। সর্বশেষ দেশছাড়া হয়েছে পুরো পরিবার।
জানা গেছে, প্রথম প্রজšে§র বেসরকারি ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে ছিলেন হুমায়ুন জহির। পোশাক খাতের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তিনি। বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের অনন্তপুরে; তাই তার ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর এই নাম।
ইউসিবি সূত্র জানায়, নোয়াখালীর হুমায়ুন জহিরের সঙ্গে ইউসিবির মালিকানায় ছিলেন চট্টগ্রামের আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। আওয়ামী লীগের কেন্দ ীয় নেতা হিসেবে ছিল তার প্রভাব, পরে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যও হয়েছিলেন তিনি। হুমায়ুন জহিরের পর ইউসিবির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন বাবু।
অভিযোগ রয়েছে, ইউসিবি থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছিলেন না আখতারুজ্জামান বাবু। হুমায়ুন জহির ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে ঋণ পরিশোধের জন্য আখতারুজ্জামান বাবুকে চাপ দিতে থাকেন। এটি মেনে নিতে পারছিলেন না বাবু। এ নিয়ে তাদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। ১৯৯৩ সালে হুমায়ুন জহিরকে ঢাকায় তার বাড়ির সামনে হত্যা করা হয়। এ সময় সন্দেহভাজন হিসেবে সামনে আসে আখতারুজ্জামান বাবুর নাম। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে বাবু গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। কিন্তু জামিনে মুক্তির পর তিনি চলে যান বিদেশে।
এদিকে হুমায়ুন জহিরের মৃত্যুর পর কঠিন দুঃসময়ে পড়ে তার পরিবার। এ সময় বলিষ্ঠ হাতে ব্যবসা ও পরিবারের হাল ধরেন স্ত্রী কামরুন নাহার। অপ্রাপ্ত বয়স্ক দুই ছেলে ও কলেজপড়ুয়া দুই মেয়েকে পড়ালেখা করিয়ে বড় করার দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। পাশাপাশি স্বামীর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান অনন্ত অ্যাপারেলসের পতাকা উড়িয়ে রাখার জন্য তার মেধা, মনন ও শ্রম ব্যয় করেন কামরুন নাহার। মায়ের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সন্তানরা বিশ্বের সুনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মানবিক মানুষ হয়ে ফিরে আসে। পাশাপাশি অনন্ত গ্রুপ তৈরি পোশাকশিল্পে অন্যতম ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
হুমায়ুন জহির পরিবার দুঃসময়েও ইউসিবির শেয়ার হাতছাড়া করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতি ও ফাইন্যান্সে পড়ালেখা শেষ করে শরীফ জহীর মায়ের সঙ্গে অনন্ত গ্রুপের হাল ধরেন। প্রতিষ্ঠানটিতে এখন ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, ১৯৯০-এর দশকে আওয়ামী লীগের অন্যতম বড় ডোনার ছিলেন আক্তারুজ্জামান বাবু। শেখ হাসিনার পরিবারের দামি গাড়িসহ সব আর্থিক প্রয়োজনে পাশে থাকতেন তিনি। হাসিনার প্রথম মার্সিডিস ব্র্যান্ডের বুলেট প্রুফ গাড়িটিও আক্তারুজ্জামান বাবু উপহার দিয়েছিলেন।
আরও জানা যায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর দেশে ফেরেন বাবু। ব্যাংকের কর্তৃত্ব নিতেও তৎপর হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৯৯ সালের ২৬ আগস্ট সশস্ত্র অবস্থায় সদলবলে ইউসিবির কর্তৃত্ব নেন বাবু। তৎকালীন চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ চৌধুরীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর ইউসিবিতে মালিকানা নিয়ে বিরোধিতার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পরের বছরই বাবু আবার ব্যাংকের পরিচালক হন।
অন্যদিকে আখতারুজ্জামান বাবু ২০১২ সালে মারা যাওয়ার পর তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণকর্তা হন ছেলে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ। ২০১৮ সালে ব্যাংকটির কর্তৃত্ব নেয় জাভেদের পরিবার। তখন তিনি ভূমিমন্ত্রী।
অভিযোগ আছে, বাবার মতোই ব্যাংকটি আবার দখল করেন তিনি। এরপর ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন জাভেদের স্ত্রী রুখমিলা জামান। ইউসিবিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, তার স্ত্রী রুখমিলা জামান ও ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী। প্রতিষ্ঠানটিকে অবৈধ টাকা আয়ের কেন্দ বানিয়ে ফেলেছিলেন তারা। ব্যাংকের ছোটখাটো কেনাকাটায় নিয়মিত কমিশন নিতেন নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ মন্ত্রী হলেও তিনি নিয়মিত বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন। মন্ত্রণালয় থেকেও ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণ করতেন। চৌধুরী পরিবারকে সহায়তা করার জন্য কিছু দালাল ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে দিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছিল। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঋণ অনিয়ম, কেনাকাটা ও অন্যান্য কাজ করা হতো।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পালিয়ে যান জাভেদ। এর পর থেকে তার কুকৃত্তির তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। লন্ডনসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় তার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, পাচার করা টাকা দিয়ে এ সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি। এ নিয়ে গত বছর আলজাজিরায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে জাভেদের সম্পদ জব্দসহ পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হয়।
সার্বিক বিষয়ে ইউসিবির চেয়ারম্যান শরীফ জহীর শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অতীতে অনেক কিছুই ঘটেছে। আমরা এখন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জোর দিচ্ছি। ব্যাংকটিকে কীভাবে দ্রুত সময়ে একটি ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যায় আমরা সেই চেষ্টা করছি।’

Discussion about this post