Print Date & Time : 18 September 2025 Thursday 9:26 am

তীব্র গ্যাস সংকট নাকাল নগরবাসী

নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : সপ্তাহখানেক ধরে টানা গ্যাস সংকট চলছে রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায়। ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী ও গাজীপুরেও বাসাবাড়িতে গ্যাসের তীব্র সংকট চলছে। সারা দিনে একবার গ্যাস আসছে না, হাঁড়িতে চড়ছে না চালডাল। অনেকেই রেস্টুরেন্টের খাবার কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছে। কেউবা অপেক্ষা করছেন গভীর রাত পর্যন্তÑকখন আসবে গ্যাস, পরিবারের সবাই মিলে খাবেন দুটি ডালভাত।

গ্যাসের অভাবে বাসাবাড়ির মতো বাণিজ্যিক কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো কারখানায় উৎপাদন প্রায় বন্ধ, কোথাও কমেছে বা স্থগিত করা হয়েছে।

বাসাবাড়িতে বাধ্য হয়ে রান্নার কাজে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছেন অনেকে। সিলিন্ডার কেনার বাড়তি খরচ বহন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এতে মানুষের মধ্যে অভিযোগ এবং অসন্তোষও বাড়ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রিন রোড, মহাখালী, আজিমপুর, আদাবর, কামরাঙ্গীরচর, আরামবাগ, ফকিরাপুল, যাত্রাবাড়ী, মৌচাক, বাসাবো, মুগদা, রামপুরা বনশ্রী, নাজিরাবাজার, মগবাজার, শনির আখড়া, ধলপুর, কাঁঠালবাগান, মিরপুর, নয়াবাজার, কল্যাণপুর, মীরবাগ, মধুবাগ, নয়াটোলা, তেজগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে লাইনের গ্যাসের তীব্র সংকট।

এসব এলাকায় দিনে রান্না করা দায় হয়ে পড়েছে। যদিও কিছুটা গ্যাস থাকে, তবে তাতে টিমটিম করে চুলা জ্বলায় রান্না করা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে এসব এলাকার বাসিন্দারা রাতে রান্না করছেন, অনেকে বাড়তি টাকা খরচ করে ব্যবহার করছেন এলপিজি সিলিন্ডার। কেউ কেউ কিনছেন ইলেকট্রিক চুলাও।

বাসাবোর বাসিন্দা রাজু  হোসেন বলেন, তীব্র গ্যাস সংকটে চুলা একেবারেই জ্বলছে না। টানা কয়েক দিন ধরে হোটেলের খাবার খেয়ে দিন পার করেছি। প্রতিটি শীত মৌসুমেই গ্যাস সংকট দেখা যায়; কিন্তু এবারের মতো প্রকট আগে দেখিনি। বাধ্য হয়ে আমরা ইলেকট্রিক চুলা কিনেছি।

মুগদা এলাকার বাসিন্দা হালিমা বেগম বলেন, পাইপলাইনের গ্যাস দিয়ে রান্না করার আশা ছেড়ে দিয়েছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও রান্না করা যায় না। আগেও সংকট ছিল, তবে কিছুদিন ধরে একেবারেই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এসব বলে তো আর লাভ নেই, হাজারবার বললেও গ্যাস পাওয়া যাবে না।

মগবাজারের এক বাসিন্দা মনি  আক্তার বলেন, গ্যাস পাওয়াই যায় না। দিনে তো লাইনের গ্যাসে রান্না করার উপায়ই নেই। রাতে কিছুটা পাই, তাও মিটমিট করে জ্বলে। বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার কিনেছি। এখন প্রতি মাসে লাইনের গ্যাসের বিল দিতে হয়, আবার সিলিন্ডারও কিনতে হয়। খরচ অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের মতো মধ্যবিত্তের জন্য কষ্ট হয়ে যায়।

বনশ্রীর বাসিন্দা মেঘ বলেন, গ্যাস আসে যায়, এমন অবস্থা। চুলায় রান্না বসালে দেখা যায় অর্ধেক রান্না হতেই গ্যাস নেই। বাধ্য হয়ে বিদ্যুতের হিটারে রান্না করি। বিদ্যুতে রান্না করলে খরচ বেশি হয়। নিয়মিত গ্যাস থাকলে এ বাড়তি খরচ হতো না।

রাজধানীর নর্দা সরকার বাড়ি সোসাইটির মুদি দোকানদার আবদুর রহিম শেয়ার বিজকে বলেন, সারাদির গ্যাস ছিল না, একবারের জন্যও গ্যাস আসেনি। এখন প্রায় রাত ১২টা, এখনো আসেনি। গ্যাস না থাকার কথা এইভাবেই তুলে ধরেন ঢাকার এই মুদি দোকানি।

রাজধানীর শনির আখড়া এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, সাত দিন ধরে চুলা একেবারেই জ্বলছে না। টানা কয়েক দিন ধরে হোটেলের খাবার খেয়ে দিন পার করেছি। বাচ্চারা বাসার খাবার খাওয়ার জন্য  কান্নাকাটি করছে কিন্তু খাওয়াতে পারছি না। আমার মেয়েটা গরুর মাংস খাবে বলে খুব ধরেছে, কিন্তু গ্যাস না থাকায় রান্না করতে পারছি না।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের গ্যাস সংকট মোকাবিলায় চারটি মূল্যায়ন এবং একটি অনুসন্ধান কূপ খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণ হিসাবে সরকার দেবে এক হাজার ২৪৪ কোটি ৮০ লাখ এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বাপেক্স) নিজস্ব তহবিল থেকে ৩১০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা খরচ করা হবে। শাহবাজপুর-৫ ও ৬, ভোলা নর্থ-৩ ও ৪ এ মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন এবং শাহবাজপুর নর্থ ইস্ট-১ এ অনুসন্ধান কূপ খনন করা হবে।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা পূরণে দেশজ গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে বর্তমান সরকার। এজন্য একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এটির আওতায় বাপেক্স ভোলা অঞ্চলে প্রস্তাবিত পাঁচটি কূপসহ মোট ২০টি কূপ খননেন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। পর্যায়ক্রমে অন্য কূপগুলোও খনন করা হবে। একনেকে উঠতে যাওয়া প্রকল্পের আওতায় যেসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে সেগুলো হলোÑভূমি উন্নয়ন, সংযোগ সড়ক নির্মাণসহ বিভিন্ন পূর্তকাজ বাস্তবায়ন। এছাড়া স্থানীয় মালামাল, রিজার্ভার সিমুলেশন সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার ক্রয়। পাশাপাশি তিন হাজার ৫০০ মিটার গভীরতায় ভোলা নর্থ-৩ ও ৪ মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ খনন, টেস্টিং কমপ্লিকেশন করা হবে। এছাড়া তিন হাজার ৫০০ মিটার গভীরে শাহবাজপুর নর্থ-১ অনুসন্ধান কূপ খনন, টেস্টিং এবং গ্যাস প্রাপ্তিসাপেক্ষে কমপ্লিকেশন সম্পন্ন করা হবে। তিন হাজার ৬০০ মিটার গভীরতায় শাহবাজপুর-৫ ও ৭ মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ খনন, টেস্টিং ও কমপ্লিকেশনের কাজ বাস্তবায়ন করা হবে।

গ্যাস সংকট নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারদর যাচাই করে। তিনি বলেন, কোনো একক উৎস থেকে নয়, বরং বিভিন্ন উৎস থেকে আমদানি করা হচ্ছে।

এদিকে বিশ্বের স্থলভাগে এ পর্যন্ত যতগুলো উত্তোলনযোগ্য গ্যাস ও তেলের খনির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলোর মজুত দ্রুত হারে কমছে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘের জ্বালানি সম্পদ পর্যবেক্ষণ-বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যানার্জি এজেন্সি (আইইএ)।

আইইএ’র এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। আইএএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বের স্থলভাগে বর্তমানে ১৫ হাজার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের খনি আছে। বছরের পর বছর ধরে এই খনিগুলো থেকে জ্বালানি সম্পদ উত্তোলনের ফলে এসব খনির ৯০ ভাগের মজুত দ্রুত হারে কমছে। অদূর ভবিষ্যতে এসব খনির মজুত পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে।

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস মজুত আছে মাত্র পাঁচ বছরের। ২০৩০ সালের মধ্যেই এ মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানেও নেই অগ্রগতি। উচ্চ দামে এলএনজি কিনতে হলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধারাবাহিকভাবে গ্যাসের উৎপাদন কমছে। বন্ধ হচ্ছে একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ঘুরছে না শিল্পকারখানার চাকা। ঠিকমতো জ্বলছে না বাসাবাড়ির চুলা। নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান না পেলে এবং নতুন খনি থেকে উত্তোলন শুরু না হলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভরতা বাড়বে। ভুক্তভোগী হবে শিল্প খাত। উচ্চ দামে এলএনজি কেনায় বাড়বে জীবনযাত্রার ব্যয়।

গ্যাস অনুসন্ধানে সরকার স্থলভাগে পুরোনো ৫০টি ও নতুন করে ১০০টি কূপ খনন ও সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যায়নি। সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানেও অগ্রগতি নেই। এ জন্য ২০৩০ সাল আসার আগেই প্রাকৃতিক গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার ধাক্কা সামলাতে সরকারকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে দেশি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে দিনে ১৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়। ২০১৭ সালে ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হতো। দেশি গ্যাসের প্রতি ইউনিটের (ঘনমিটার) দাম তিন টাকার মতো। বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজির দাম ৫৫ টাকা। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) সর্বশেষ সমীক্ষা (২০১০) অনুযায়ী দেশে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত আছে ২৮ দশমিক ৭৯ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন বা লাখ কোটি ঘনফুট)। ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৩৩ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়। বাকি আছে প্রায় ৯ (৮ দশমিক ৪৬) টিসিএফ গ্যাস।