নিজস্ব প্রতিবেদক : তেজস্ক্রিয় পদার্থ সন্দেহে শনাক্ত হওয়া লোহার স্ক্র্যাপ এবং শিল্পের কাঁচামাল বোঝাই ১৩টি কনটেইনার নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের পাশাপাশি চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস। আটকে পড়া এসব কনটেইনার আইনি জটিলতায় রপ্তানিকারক দেশে ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না। তাছাড়া সমন্বয়হীনতার কারণে বন্দর থেকে অপসারণ করাও হচ্ছে না। ঝুঁকি বিবেচনায় এসব কনটেইনার দুই সপ্তাহের মধ্যে অপসারণে কাস্টমস হাউসকে চিঠি দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায় বন্দরে স্থাপন করা বিশেষায়িত প্রবেশদার অতিক্রম করার সময় এসব কনটেইনারে তেজস্ক্রিয় পদার্থ শনাক্ত করা হয়। সবশেষ গত ৩ আগস্ট ব্রাজিল থেকে আসা লোহার স্ক্র্যাপ বোঝাই একটি কনটেইনারে ২ দশমিক ১৬ মাত্রার সি এস-ওয়ান থ্রি সেভেন এবং টি এইচ-টু থ্রি টু তেজস্ক্রিয় পদার্থ ধরা পড়ে।
গত পাঁচ বছরে লোহার স্ক্র্যাপ, সিরামিকের কাঁচামাল এবং জিংক ওয়েস্ট বোঝাই ১৩টি কনটেইনারে এ ধরনের তেজস্ক্রিয় পদার্থ শনাক্ত করেছে পরমাণু শক্তি কমিশন। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ড. শাহাদাত হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস ও পরমাণু শক্তি কমিশনের মধ্যে কোনো সমঝোতা চুক্তি না থাকায় এসব পণ্যের তত্ত্বাবধান কে করবে, তা ঠিক করা যাচ্ছে না।
বিগত ২০১৪ সালে প্রথমবার চট্টগ্রাম বন্দরে স্ক্র্যাপ বোঝাই কনটেইনারে তেজস্ক্রিয় পদার্থ শনাক্ত করা হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর ৩-৪টি কনটেইনারে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ধরা পড়লেও, যদি তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা সহনীয় থাকে, তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কেবল ২ দশমিক ৩ মাত্রার বেশি হলে কনটেইনারগুলো আটকে রাখা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন সময়ে শনাক্ত হওয়া ১৩টি তেজস্ক্রিয় ধাতব বস্তু আপাতত কনটেইনার ভর্তি অবস্থায় মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের একটি পয়েন্টে রাখা হয়েছে। বন্দর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো যত দ্রুত সম্ভব অপসারণ করতে পারলে চট্টগ্রাম বন্দর ঝুঁকিমুক্ত হবে।
এদিকে, তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকা কনটেইনারের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে এসব কনটেইনার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কাছে একাধিকবার চিঠি দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক জানিয়েছেন, এসব কনটেইনার দ্রুত নিষ্পত্তি জরুরি। কারণ সেগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এ ধরনের পণ্য দ্রুত সরিয়ে ফেলতে কাস্টমসকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
অন্য পণ্যের সঙ্গে আসা তেজস্ক্রিয় পদার্থ ফেরত পাঠানোর নিয়ম থাকলেও তা ঠিকমতো কার্যকর হচ্ছে না। এছাড়া পরমাণু শক্তি কমিশনের সঙ্গে বন্দর বা কাস্টমসের চুক্তি না থাকায় এসব পদার্থ অপসারণে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি কমিশনের ছাড়পত্র নিয়ে পণ্যবোঝাই এসব কনটেইনার নিলামে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস।
প্রতিষ্ঠানটির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমান বলেন, কাস্টমস আইন অনুযায়ী এসব পণ্য দ্রুত নিলামে তোলা হবে। তবে পরমাণু শক্তি কমিশনের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে না।
শুধু আমদানি পণ্যের সঙ্গে তেজস্ক্রিয় পদার্থ এসেছে এমনটা নয়। জাহাজ কাটা শিল্পের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মধ্যেও পরমাণু শক্তি কমিশনের পরীক্ষায় তেজস্ক্রিয় পদার্থ ধরা পড়েছে। অন্তত তিন ধাপে পরীক্ষা শেষে এসব পদার্থ ঢাকার সাভারে থাকা তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবস্থাপনা কেন্দে সংরক্ষণ করা হয়।
শুধু তাই নয়, বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে থাকা ৩৫৭ কনটেইনারে সালফিউরিক অ্যাসিড, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইডের মতো বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থও রয়েছে।
এদিকে ১০ থেকে ১৫ বছরের পুরোনো এসব কনটেইনার নষ্ট হয়ে বাইরে গড়িয়ে পড়ছে রাসায়নিক। লেবাননের বৈরুতের মতো যে কোনো সময় এসব কনটেইনারে বিস্ফোরণের আশঙ্কা করছে খোদ বন্দর কর্তৃপক্ষই। বিপজ্জনক এই কনটেইনার সরাতে চট্টগ্রাম কাস্টমসকে এক ডজনের বেশি চিঠি দিয়েছে তারা। কাস্টমস আবার চিঠি দিয়েছে পরমাণু শক্তি কমিশনকে। এভাবে চিঠি চালাচালি চললেও অপসারণ হচ্ছে না কনটেইনার, বাড়ছে বিপদও।
১৪ বছরের পুরোনো চারটি কনটেইনারে থাকা তরল রাসায়নিক ২০২৪ সালে ইয়ার্ড থেকে খালাস করা হয়। তবে এখনও চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এবং ওভারফ্লো ইয়ার্ডের বিভিন্ন স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ এসব কনটেইনার রয়ে গেছে। এসব কনটেইনারের অনেকগুলো ভাঙা, কোনোটিতে পাউডার জাতীয় রাসায়নিক, আবার কোনোটিতে তরল রাসায়নিক রয়েছে। এসব কনটেইনারের মধ্যে পাতলা ক্যালসিয়াম কার্বনেট, সালফেট, সোডিয়াম সালফেট বোঝাই ৯টি কনটেইনার রয়েছে। এ ছাড়া ১০ থেকে ২০ বছর ধরে ওভারফ্লো ইয়ার্ডে অতি বিপজ্জনক হিসেবে পরিচিত সালফিউরিক অ্যাসিড, জিংক অক্সাইড, পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইড, মিথানল, সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড, ফসফরিক এসিড, ইথাইল অ্যাসিটেট ও কস্টিক সোডা বোঝাই আরও ১৩৪টি কনটেইনার পড়ে রয়েছে।