শেয়ার বিজ ডেস্ক : আন্তর্জাতিক লজিস্টিকস সূচকে সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা অগ্রগতি হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এখনো সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল আয়োজিত ‘চ্যালেঞ্জেস, অপরচুনিটিজ অ্যান্ড ওয়ে ফরওয়ার্ড ইন শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস ল্যান্ডস্কেপ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহাপরিচালক ড. আহমেদ উল্লাহ। সভাপতিত্ব করেন দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের অধ্যাপক ড. মো. মামুন হাবিব।
অ্যাগিলিটি ইমার্জিং মার্কেটস লজিস্টিকস ইনডেক্স (এইএমএলআই) অনুযায়ী, লজিস্টিকস খাতে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করেছে। ২০২২ সালে ৫০টি উদীয়মান দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৯তম, যা ২০২৩ সালে ৩৫তম ও সর্বশেষ ২০২৪ সালে আরো দুই ধাপ এগিয়ে ৩৩তম স্থানে উন্নীত হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের লজিস্টিকস পারফরম্যান্স ইনডেক্স (এলপিআই) ২০২৩ অনুযায়ী, ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তম, যেখানে স্কোর ছিল ৫-এর মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ৬। তালিকায় ভারতের অবস্থান ৩৮ ও শ্রীলংকার ৭৩। এছাড়া বিশ্বব্যাংক গ্রুপের কনটেইনার পোর্ট পারফরম্যান্স ইনডেক্স (সিপিপিআই) ২০২৩ অনুযায়ী, শ্রীলংকার কলম্বো বন্দর বিশ্বব্যাপী ৪০তম স্থানে রয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৩৩৯তম। এ সূচক বন্দরের কার্যক্ষমতা মূল্যায়নে ব্যবহৃত হয়, যেখানে জাহাজের আগমন, টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম ও সামগ্রিক দক্ষতা বিবেচনা করা হয়।
লজিস্টিকস উন্নয়নে দেশ পাঁচ দশক পিছিয়ে রয়েছে উল্লেখ করে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘মার্কিন শুল্ক এবং এলডিসি থেকে উত্তরণের কারণে রফতানি ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও লজিস্টিকসের দক্ষতা বাড়িয়ে তা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব।’ এজন্য চট্টগ্রাম বন্দরকে বেসরকারি অপারেটরদের জন্য উন্মুক্ত করা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বন্দর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়াতে বিদেশী অপারেটর নিয়োগের সিদ্ধান্ত সমর্থন করা উচিত। তারা বন্দর ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। এতে স্থানীয় কর্মীরা আধুনিক প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক মানের অনুশীলন শিখতে সক্ষম হবেন। ১০০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দ্রুত বে টার্মিনাল চালু করা এবং মোংলা ও পায়রা বন্দরের সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার করা দরকার।’
চট্টগ্রাম বন্দরে হঠাৎ ৪০ শতাংশ চার্জ বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বন্দর একটি সেবাভিত্তিক সংস্থা। কোনো আলোচনা বা যৌক্তিক ব্যাখ্যা ছাড়া আকস্মিকভাবে চার্জ বৃদ্ধি অযৌক্তিক।’
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে বর্তমানে পাঁচ-ছয়দিন সময় লাগে, যেখানে বৈশ্বিক মান অনুযায়ী এক-দুইদিন লাগে। এছাড়া প্রায়ই ক্রেতাদের প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য আকাশপথে পণ্য পাঠাতে বাধ্য হই, যার খরচ সমুদ্রপথের চেয়ে চার গুণ বেশি।’
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘চট্টগ্রামের বে টার্মিনালে একটি মাল্টিমোডাল লজিস্টিকস হাবের নির্মাণকাজ শিগগিরই শুরু হবে। পরিকল্পিত ব্যবস্থার মাধ্যমে রেল, সড়ক ও সমুদ্রপথকে সমন্বয় করে পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় এটি সমন্বয় করা হবে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বে টার্মিনাল ব্রেকওয়াটার প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। বে টার্মিনালের জন্য দরপত্র মূল্যায়ন এক-দুই মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০৩৬ সালের মধ্যে বে টার্মিনাল ৫ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন টিইইউ কনটেইনার পরিচালনা করতে সক্ষম হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বে টার্মিনাল একটি পিপিপি মডেলে জিটুজি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত একটি বে টার্মিনাল ঠিকাদারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এছাড়া নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনালও একটি স্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক অপারেটরের কাছে হস্তান্তর করা হবে।’
জাতীয় লজিস্টিকস নীতি প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ সচিব বলেন, ‘এটি শিগগিরই সংশোধন করা হবে। এরই মধ্যে দুটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এক মাসের মধ্যে এ নীতির অধীনে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হবে।’
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, বিওজিএসওএর সভাপতি আজম জে চৌধুরী, বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ, বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ট্রান্সপোর্ট স্পেশালিস্ট নুসরাত নাহিদ বাবি, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি ফজলী শামিম এহসান, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ ও জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ ইকবাল আলী শিমুল, বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান, বাংলাদেশ কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন চৌধুরী ও সদস্য হারুন অর রশিদ এবং বিজিএপিএমইএর সভাপতি মো. শাহরিয়ার।
আরআর/