নিজস্ব প্রতিবেদক : জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা ও সমাবেশকে ঘিরে গোপালগঞ্জে দফায় দফায় হামলা ও সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ায় অন্তত চারজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
গতকাল বুধবার দুপুর থেকে চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এ সংঘাতে বহু মানুষ আহত হয়েছেন।
গতকাল রাত ৮টায় হাসপাতালে চারজনের মরদেহ আনার খবর নিশ্চিত করেছেন গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জীবিতেষ বিশ্বাস।
নিহতরা হলেন: শহরের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (৩০), কোটালিপাড়ার হরিণাহাটি গ্রামের কামরুল কাজীর ছেলে রমজান কাজী (১৯), শহরের শানাপাড়ার সোহেল রানা (৩৫) এবং সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন।
এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম) খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, তারা তিনজনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। তবে এই সংখ্যা বাড়তে পারে।
দুপুর থেকে চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এ সংঘাতে বহু মানুষ আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৫ জনকে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পর গুরুতর আহত তিনজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
এনসিপির এই পদযাত্রা ও সমাবেশ ঘিরে গত মঙ্গলবার থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়।
গতকাল সকালে এনসিপি নেতারা গাড়িবহর নিয়ে শহরে ঢোকার আগেই পুলিশের গাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ঘটনার সূত্রপাত হয়। পরে ইউএনওর গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে।
এসবের মধ্যে বেলা ড়েটায় নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা মিছিল করে এসে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে গোপালগঞ্জ শহরের পৌরপার্ক এলাকায় সমাবেশ মঞ্চে হামলা চালায়।
সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে নেতারা পুলিশি নিরাপত্তায় টেকেরহাট হয়ে মাদারীপুর যাওয়ার পথে বেলা পৌনে ৩টায় শহরের লঞ্চঘাট এলাকায় গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে ফের হামলা হয়। এ সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের সংঘর্ষে গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
এ পরিস্থিতিতে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। দুপুরে জেলা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। পরে গতকাল রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জে কারফিউ জারির কথা জানায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
এদিকে গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে গতকাল আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এই আল্টিমেটাম ঘোষণা করেন সংগঠনের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদি।
হাদি বলেন, ‘আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে শুক্রবার হাজার হাজার মানুষ নিয়ে গোপালগঞ্জ অভিমুখে লং মার্চ করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই দেশে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি আছে। আমাদের তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ঝগড়া আছে। কিন্তু জুলাই ও স্বাধীনতার সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো ঝগড়া নেই। এনসিপির উদ্দেশে বলছি, এই সরকারে তোমাদের দুই ভাই আছে, আসিফ মাহমু আর মাহফুজ আলম। যদি সরকারে থেকেও তোমারে গোপালগঞ্জে নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে সারা দেশের নিরাপত্তা কোথায়?’
শাহবাগ থানার সামনে অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে হাদি বলেন, আমরা এখন শাহবাগ থানায় যাচ্ছি। আমাদের ভাইরে নিরাপে ফিরিয়ে না আনলে কাউকেই এখানে মুক্ত থাকতে য়ো হবে না। শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি হবে, কিন্তু কেউ যি উসকানি দেয়, স্যান্ডেল মেরে মুখের দাঁত ফেলে দেয়া হবে।
হাদি বলেন, গোপালগঞ্জের প্রতিটি উপজেলাকে মাদারীপুর ও ফরিদপুরের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
ইনকিলাব মঞ্চের আরেক নেতা আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, এই ষড়যন্ত্রের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো জুলাই সনদ বাতিল করা। যতদিন দিল্লির হনুমানগুলো গোপালগঞ্জে থাকবে, ততদিন জুলাই সনদ আদায় হবে না। তাই সনদ পেতে হলে তাদের সবাইকে রাবণে পাঠাতে হবে।
সমাবেশ শেষে টিএসসি থেকে মিছিল করে ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীরা শাহবাগ থানার সামনে অবস্থান নেন। এ সময় তারা ‘মুজিববাদ নিন্দাবাদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, মুজিববাদ মুর্দাবাদ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, গোলাপিদের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও, লাল জুলাইয়ের হাতিয়ার, গর্জে ওঠো হাতিয়ার’ প্রভৃতি স্লোগান দেন।
এ ছাড়া গোপালগঞ্জে এনসিপির ওপর হামলার প্রতিবাদে আজ দেশের সব জেলা ও মহানগরীতে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গতকাল বুধবার দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এক বিবৃতির মাধ্যমে এই কর্মসূচির ঘোষণা করেন।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, বুধবার গোপালগঞ্জ জেলায় এনসিপির পূর্বঘোষিত মার্চ টু গোপালগঞ্জ কর্মসূচিতে পতিত স্বৈরাচারের দোসর নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা নৃশংস হামলা চালায়। তারা এনসিপির নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে তাদের গাড়িতে হামলা করে এবং তাদের অবস্থানস্থল এসপির অফিসেও হামলা চালায়। সন্ত্রাসীদের হামলায় এনসিপির বহুসংখ্যক নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণ আহত হয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, সন্ত্রাসীরা অগ্নিসংযোগ করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। তারে সৃষ্ট সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বাংলাশে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দেশের সব জেলা/মহানগরীতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো।
হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমি এ কর্মসূচি পালনের জন্য সংগঠনের সর্বস্তরের জনশক্তি ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

Discussion about this post