নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেয়ার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। ডিসেম্বরের মধ্যেই এ দায়িত্ব হস্তান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে চুক্তির খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া সরাসরি জিটুজি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) পদ্ধতিতে অপারেটর নিয়োগের উদ্যোগ। শুধু এনসিটি নয়, ভবিষ্যতে বে-টার্মিনাল প্রকল্পের একটি টার্মিনালও ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দিয়ে পরিচালনার চিন্তাভাবনা করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে ল্যান্ডলর্ড মডেলে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগ করা হয়। অথচ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কনটেইনার টার্মিনালটিতে সেই প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে সরাসরি ডিপি ওয়ার্ল্ডের কাছে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ল্যান্ডলর্ড মডেলে বেসরকারি অপারেটর নিজের অর্থায়নে অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিচালনা করে। কিন্তু এনসিটিতে ইতোমধ্যে ভারী যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য বিনিয়োগ করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ফলে এ প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি ল্যান্ডলর্ড মডেল বলা যাবে না।
২০০৮ সালে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হলেও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের হস্তক্ষেপের অভিযোগে তা শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়। গত বছর ক্ষমতাচ্যুত সরকার আবারও বিদেশি অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছিল, যা এখন অন্তর্বর্তী সরকার এগিয়ে নিচ্ছে। বর্তমানে নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেড (সিডিডিএল) সাময়িকভাবে এনসিটি পরিচালনা করছে।
নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপারেটর ছাড়া বন্দর উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে শত শত বন্দর পরিচালনা করছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বয়স ১৪০ বছর হলেও এখনও বিশ্বমঞ্চে পরিচিত নয়। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে না আনলে আমরা বর্তমান অবস্থায়ই থেকে যাব।’
চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান জানান, ‘বিদেশি অপারেটররা গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডে কাজ করে। তারা শীর্ষ শিপিং কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের চাপ সামলাতে পরিচালন দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিদেশি অভিজ্ঞতা জরুরি।’
শ্রমিক সংগঠন, পেশাজীবী ও রাজনৈতিক মহল বলছে, এনসিটিতে ইতোমধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। ভারী যন্ত্রপাতি আরও অন্তত ২২-২৩ বছর কার্যকর থাকবে। তাই নতুন বড় কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই সাজানো-গোছানো কার্যকর টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়ার যৌক্তিকতা নেই।
এভারেস্ট পোর্ট সার্ভিসেস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘নতুন টার্মিনালে অবকাঠামো না থাকায় বিদেশি অপারেটরের বিষয়ে তেমন আপত্তি নেই। কিন্তু এনসিটি ইতোমধ্যেই কার্যকর এবং লাভজনক। জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থ বিবেচনায় এখানে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকতে হবে।’
সীকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক মনে করেন, দরপত্রের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি যৌথ অপারেটর নিয়োগ করলে প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ তৈরি হতো।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে চারটি কনটেইনার টার্মিনাল চালু আছেÑ নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি) ও পতেঙ্গার রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি)। এর মধ্যে এনসিটি ২০০৭ সালে আংশিক এবং ২০১৫ সালে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়। দীর্ঘদিন এটি সাইফ পাওয়ারটেকের অধীনে পরিচালিত হলেও এখন সিডিডিএলের দায়িত্বে রয়েছে।
চলতি বছরের জুলাইয়ে এনসিটির দায়িত্ব নিয়ে সিডিডিএল মাত্র আড়াই মাসেই কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ৯ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা ২ লাখ ৭৬ হাজার ১৫৩ কনটেইনার হ্যান্ডল করেছে, যা গত বছর একই সময়ে সাইফ পাওয়ারটেকের পরিচালনার তুলনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
চবক চেয়ারম্যান বলেন, ‘সিডিডিএলের অধীনে অপচয় কমেছে, জাহাজের টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম হ্রাস পেয়েছে, কার্যকারিতা বেড়েছে।’