ড. মতিউর রহমান : ‘অ্যানথ্রোপোসিন’ শব্দটি নিছক একটি নতুন ভূতাত্ত্বিক যুগের সূচক নয়, বরং এটি মানবজাতি এবং প্রকৃতির মধ্যে আধুনিক সম্পর্কের এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন। এই যুগ মানুষের কর্মকাণ্ডের দ্বারা পৃথিবীর ভূ-প্রকৃতি, আবহাওয়া এবং বাস্তুতন্ত্রে আমূল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে ‘মানবজাতি’ কোনো একক, অভিন্ন সত্তা নয়। বরং প্রশ্নটি হলো কোন মানুষ? কোন শ্রেণি? কার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা? এই প্রশ্নগুলোই অ্যানথ্রোপোসিন সমাজতত্ত্বের ভিত্তি তৈরি করেছে, যা ২০১০-এর দশকে বিকশিত হয় এবং এর প্রভাবশালী তাত্ত্বিকদের মধ্যে আন্দ্রেয়াস মাল্ম ও জেসন ডব্লিউ. মুর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই তাত্ত্বিকরা আমাদের বুঝতে সাহায্য করেন যে, জলবায়ু সংকট নিছক পরিবেশগত সমস্যা নয়, বরং এটি আমাদের সমাজ, অর্থনীতি এবং ক্ষমতার কাঠামোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আন্দ্রেয়াস মাল্ম তার সুপরিচিত গ্রন্থ ঋড়ংংরষ ঈধঢ়রঃধষ (২০১৬)-এ জোরালোভাবে যুক্তি দিয়েছেন, শিল্পবিপ্লবের সময়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কোনো প্রাকৃতিক বা প্রযুক্তিগত অনিবার্যতা ছিল না। বরং এটি ছিল মূলত একটি রাজনৈতিক ও শ্রেণিভিত্তিক সিদ্ধান্ত, যা শ্রমশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পুঁজির সংরক্ষণে উৎসাহিত করেছিল। মাল্ম দেখিয়েছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি কেবল একটি শক্তির উৎস ছিল না; এটি ছিল সামাজিক ক্ষমতার একটি শক্তিশালী অস্ত্র, যা ধনী দেশগুলোর শিল্পায়ন ও সাম্রাজ্যবাদকে সম্ভব করে তোলে। ১৮০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, ব্রিটিশ শিল্পপতিরা জলবিদ্যুতের সহজলভ্যতা সত্ত্বেও কয়লা চালিত বাষ্পীয় ইঞ্জিন বেছে নিয়েছিলেন। এর কারণ ছিল কয়লার সরবরাহ ছিল অধিক নিয়ন্ত্রণযোগ্য এবং এটি শ্রমিকদের ওপর পুঁজিবাদের ক্ষমতাকে দৃঢ় করতে সাহায্য করেছিল, কারণ জলবিদ্যুতের জন্য নদী বা ঝরনার আশপাশে কারখানা স্থাপন করতে হতো, যেখানে শ্রমিকদের গ্রাম বা কৃষিজমি থেকে সরিয়ে আনা কঠিন ছিল। কয়লার মাধ্যমে কারখানার অবস্থান শ্রমিকদের সহজলভ্যতার ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পুঁজির পছন্দ অনুযায়ী সম্ভব হয়েছিল। এই বিশ্লেষণের গভীরতা আমাদের উপলব্ধি করায়, আজকের জলবায়ু বিপর্যয় কোনো ‘প্রাকৃতিক’ দুর্যোগ নয়, বরং এটি পুঁজিবাদী আধিপত্যের প্রত্যক্ষ ফল। এই সংকট আধুনিক বিশ্ব অর্থনীতির জš§লগ্ন থেকেই পুঁজির সীমাহীন বিকাশের ধারণার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
জেসন ডব্লিউ. মুর তার গ্রন্থ ক্যাপিটালাইজেশন ইন দ্য ওয়েব অব লাইফ (২০১৫)-এ মাল্মের ধারণাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে বলেছেন, আমরা এখন অ্যানথ্রোপোসিন নয়, বরং ক্যাপিটালোসিন বা পুঁজিবাদ-যুগে বাস করছি। তার মতে, পুঁজিবাদ কেবল প্রকৃতিকে শোষণ করে না, বরং এটিকে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী পুনর্গঠন করে। নদী, বন, প্রাণী, এমনকি জলবায়Ñসবকিছুই পুঁজির বৃদ্ধির সামগ্রীতে পরিণত হয়। উদাহারণস্বরূপ, অ্যামাজন বনাঞ্চলকে কেবল গাছপালা বা প্রাণীর বাসস্থান হিসেবে না দেখে, পুঁজিবাদ একে সয়াবিন চাষ বা গবাদি পশু পালনের জন্য বিশাল ভূখণ্ড হিসেবে দেখে, যা বিশ্ববাজারে মুনাফা বাড়াতে পারে। এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তন কোনো বহিরাগত পরিবেশগত সংকট নয়, বরং এটি পুঁজিবাদেরই অন্তর্গত সংকট; যা তার অমিত চাহিদা এবং অসীম বৃদ্ধির প্রবণতার মধ্যে নিহিত। পুঁজিবাদের এই স্ব-ধ্বংসাত্মক প্রকৃতিই আমাদের গ্রহকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে প্রকৃতির নিজস্ব ভারসাম্য এবং পুনরুজ্জীবনের ক্ষমতাকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়।
এই গভীর সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমাদের দৃষ্টিকে বাংলাদেশের বাস্তবতার দিকে নিয়ে আসে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে প্রায়শই জলবায়ু পরিবর্তনের ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি হলো পুঁজিবাদী শোষণের এক ভয়াবহ ফ্রন্টলাইন। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত এই বদ্বীপ অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং নদীভাঙন নিছকই প্রকৃতির খেলা নয়; বরং এই ভূখণ্ডে ঘটে যাওয়া প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগই ইতিহাসের বৈষম্য, বৈশ্বিক ঔপনিবেশিকতা এবং বিশ্ব অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতার সুদূরপ্রসারী ফল। সিডর, আইলা, আম্পান বা সাম্প্রতিক বন্যাগুলো একটি বৃহৎ বৈশ্বিক কাঠামোর অংশ; যা পৃথিবীর উত্তরাংশের শিল্পোন্নত দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানির চরম ব্যবহারের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছে, এবং দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোকে সেই ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হিসেবে রেখে দিয়েছে। এই বিভেদ কেবল প্রাকৃতিক নয়, এটি গভীর অর্থনৈতিক ও ক্ষমতার অসমতার প্রতিচ্ছবি, যেখানে ধনী দেশগুলো তাদের ঐতিহাসিক কার্বন নিঃসরণের দায়ভার এড়িয়ে দরিদ্র দেশগুলোকে সংকটের মুখে ঠেলে দেয়।
সুন্দরবনের পরিবেশগত সংকট কেবল সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বা লবণাক্ততা বৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর পেছনে রয়েছে আরও গভীর কারণ। উপকূলীয় চিংড়ি খামারগুলোর পরিবেশবিধ্বংসী কার্যক্রম, যা সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পলি সঞ্চালন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করছে এবং মিঠাপানির উৎসকে লোনা পানিতে রূপান্তরিত করছে, তা অন্যতম প্রধান কারণ। এর পাশাপাশি, জল ব্যবস্থাপনায় প্রতিবেশী দেশগুলোর দখলদার মনোভাব, বিশেষ করে উজান থেকে আসা নদীর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ, সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এছাড়া বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের নামে অন্ধ উন্নয়ননীতি, যেমন সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, এখানকার নাজুক বাস্তুতন্ত্রকে আরও সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
একইভাবে ঢাকার জলাবদ্ধতা শুধু অতিবৃষ্টির ফল নয়; এর মূলে রয়েছে অব্যবস্থাপনা, মুনাফাভিত্তিক আবাসন শিল্প যা জলাভূমি ও খাল ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে আবাসন তৈরি করছে এবং শহরের দরিদ্র মানুষদের পরিকল্পনাহীনভাবে উচ্ছেদ, যা তাদের জীবন ও জীবিকাকে সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত করে তোলে। এসব ঘটনা মাল্মের ভাষায় সোশিও-ইকোলজিক্যাল সাবোটাজÑঅর্থাৎ সমাজ ও প্রকৃতির সমন্বিত ধ্বংসযজ্ঞের স্পষ্ট উদাহরণ, যেখানে পুঁজিবাদ নিজের লাভের জন্য মানুষ ও প্রকৃতি উভয়কেই ব্যবহার করে এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করে। বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়া প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করা যায়Ñসাধারণ মানুষ তাদের ভূমি হারায়, কৃষিজমি ক্ষারিত হয় এবং গ্রামের মানুষ শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, যা তাদের জীবন ও জীবিকাকে সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত করে তোলে।
জলবায়ুজনিত অভিবাসন এখন বাংলাদেশের এক নির্মম বাস্তবতা, বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনা বা পটুয়াখালীর মতো উপকূলীয় অঞ্চলে। সেখানকার মানুষ প্রাকৃতিক কারণে নয়, বরং মানবসৃষ্ট কারণেই তাদের বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের কারণে হাজার হাজার পরিবার তাদের কৃষিজমি ও বাসস্থান হারিয়ে শহরের বস্তি বা নতুন আশ্রয়স্থলে ভিড় করছে। এই অভিবাসীরা প্রায়ই তাদের নতুন পরিবেশে বৈষম্য, শোষণ এবং মৌলিক সেবার অভাবের শিকার হন। বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী যে দেশগুলো, তারা এখন ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স এবং সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের মতো শব্দবন্ধ ব্যবহার করে বাংলাদেশকে কৃত্রিমভাবে গর্বিত করে তোলে, অথচ প্রকৃত সহানুভূতি বা কাঠামোগত পরিবর্তনের কোনো ইচ্ছাই তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। এটি কেবল কথার মারপ্যাঁচ, যা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রতি তাদের প্রকৃত দায়বদ্ধতাকে আড়াল করে এবং তাদের ঐতিহাসিক কার্বন নির্গমনের দায় থেকে মুক্ত করে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে অ্যানথ্রোপোসিন সমাজতত্ত্ব আমাদের সহনশীলতা” (ৎবংরষরবহপব) বা “অভিযোজন” (ধফধঢ়ঃধঃরড়হ)-এর প্রচলিত ধারণাগুলোর সমালোচনা করতে শেখায়। এ ধারণাগুলো শুনতে ইতিবাচক মনে হলেও বাস্তবে তা দুর্যোগের শিকার মানুষের ওপর এক নৈতিক ভার চাপিয়ে দেয়। আর্থরাজনৈতিক কাঠামো, পুঁজিবাদী প্রবৃদ্ধির সীমাহীন লালসা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের দায় এড়ানোর প্রবণতাকে উপেক্ষা করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কেবল ‘খাপ খাইয়ে নিতে’ বলা হয়। এটি এমন এক ধরনের পরামর্শ, যা সমস্যার মূল কারণকে এড়িয়ে যায় এবং সমাধানের ভার কেবল ক্ষতিগ্রস্তদের ওপর চাপিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যখন একটি উপকূলীয় গ্রামের মানুষকে লবণাক্ততার কারণে তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশা ছেড়ে অন্য পেশা গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়, তখন তা তাদের সংস্কৃতি, জ্ঞান এবং জীবনযাত্রার ওপর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চাপকে আড়াল করে।
বিশেষভাবে বাংলাদেশের নারী সমাজ, যারা পরিবেশ সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তারা প্রায়ই উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় প্রান্তিক ও নির্জীবভাবে উপস্থাপিত হন। পানি সংকট, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু-সম্পর্কিত স্বাস্থ্যঝুঁকি নারী ও শিশুদের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। কারণ তাদের দৈনন্দিন জীবন জল এবং খাদ্যের উৎসের ওপর বেশি নির্ভরশীল। পুরুষরা যখন কাজের সন্ধানে শহর বা অন্যত্র চলে যায়, তখন নারীদের ওপর পরিবার ও সংসারের ভার আরও বেড়ে যায়। কিন্তু তাদের কোনো নীতিনির্ধারণী আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, তাদের অভিজ্ঞতা বা মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। এটি সমাজে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের আরেকটি রূপÑযা অ্যানথ্রোপোসিনের তথাকথিত ‘মানবজাতি’র সার্বজনীনতার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। নারীদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানকে বাদ দিয়ে কোনো টেকসই সমাধান সম্ভব নয়।
অ্যানথ্রোপোসিন সমাজতত্ত্ব আমাদের সময়ের ধারণাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। উন্নয়নের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী সময় একটি সরলরেখায় অগ্রসরমান প্রক্রিয়া, যেখানে অগ্রগতি ক্রমান্বয়ে ঘটে। কিন্তু জলবায়ু সংকট সেই ধারাকে ভেঙে দেয়। এটি আমাদের ংষড়ি ারড়ষবহপব এবং ফববঢ়রসবক্সএই দুটি জটিল সময় ধারণার মুখোমুখি দাঁড় করায়। ঝষড়ি ারড়ষবহপব হলো এমন এক ধরনের সহিংসতা যা ধীরে ধীরে, অদৃশ্যভাবে এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে, যেমন ধীরে ধীরে মাটি লবণাক্ত হওয়া বা নদীর ভাঙন যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রভাবিত করে। উববঢ়রসব হলো ভূ-তাত্ত্বিক সময়, যা মানব ইতিহাসের তুলনায় অনেক দীর্ঘ এবং যেখানে মানবসৃষ্ট পরিবর্তনগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আমাদের বর্তমানের অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষ প্রতিদিন অনুভব করেÑসময় যেন এক ধীর কিন্তু নিশ্চিত ধ্বংসের গতি; যেখানে অতীত স্মৃতি এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা প্রতিনিয়ত বর্তমানকে রক্তাক্ত করে তোলে। এই ধীর সহিংসতা অদৃশ্য হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং প্রজš§ থেকে প্রজন্মান্তরে বিস্তৃত, যা মানুষের মনস্তত্ত্ব এবং সামাজিক কাঠামোর ওপর গভীর চাপ সৃষ্টি করে।
এই ভয়াবহ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে আমাদের করণীয় কী? প্রথমত, সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের দুর্যোগকে ‘প্রাকৃতিক’ ভাবা বন্ধ করতে হবে। দুর্যোগ মানেই প্রকৃতির রোষ নয়, বরং এটি একটি সমাজ-রাজনৈতিক ঘটনার বহিঃপ্রকাশ। এ উপলব্ধিই আমাদের সমাধানের দিকে প্রথম ধাপ। আমাদের বুঝতে হবে যে, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় শুধু আবহাওয়াগত ঘটনা নয়, বরং এগুলোর তীব্রতা এবং প্রভাব আমাদের বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর দুর্বলতাকে প্রকাশ করে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় জনগোষ্ঠীÑচাষি, জেলে, নারী, পরিবেশকর্মীÑতাদের অভিজ্ঞতা, মতামত ও জ্ঞানকে কেন্দ্র করে নীতি নির্ধারণে আনতে হবে। তারাই প্রকৃত অর্থে সংকটের মুখোমুখি এবং তাদের অভিজ্ঞতানির্ভর জ্ঞানই সবচেয়ে কার্যকর সমাধান দিতে পারে। তাদের জীবনযাত্রার ধরন, অভিযোজনের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি এবং প্রকৃতির সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়ে নীতি প্রণয়ন করা উচিত। তৃতীয়ত, উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবস্থাপনাকে শুধু প্রযুক্তিগত সমাধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, ন্যায্যতা, ক্ষমতা ও অধিকারভিত্তিক কাঠামোয় রূপান্তর করতে হবে। এটি শুধু বাঁধ নির্মাণ বা সাইক্লোন শেল্টার তৈরির মতো প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রশ্ন। জলবায়ু তহবিল থেকে প্রাপ্ত অর্থ যেন প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছায় এবং তারা যেন তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
অ্যানথ্রোপোসিনের সমাজতত্ত্ব শুধু একটি নতুন তাত্ত্বিক প্রবণতা নয়; এটি আমাদের জন্য একটি অস্তিত্বগত প্রশ্ন। আমরা কীভাবে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকব? কার দায়ভার আমাদের বিপন্নতার জন্য? কারা আমাদের ধ্বংসের বিনিময়ে লাভবান হচ্ছে? এ প্রশ্নগুলোকে সামনে আনাই এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে জলবায়ু সংকট প্রতিদিন ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছে, সেখানে এই সমাজতত্ত্ব শুধু বিশ্লেষণ নয়Ñএটি প্রতিরোধের এক শক্তিশালী অস্ত্র। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন চাই, তবে এই পুঁজিবাদী উন্নয়নের আখ্যানকে ভাঙতেই হবেÑনতুবা সহ্য করতে হবে ভবিষ্যতের অনিবার্য দহন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেবল প্রকৃতির হাতে নয়, বরং আমাদের সম্মিলিত সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের ওপর নির্ভর করছে। এই লড়াই কেবল পরিবেশ রক্ষার লড়াই নয়, এটি ন্যায়বিচার, সমতা এবং মানবজাতির টিকে থাকার লড়াই।
গবেষক ও উন্নয়নকর্মী