শেখ শাফায়াত হোসেন : একসঙ্গে ৯টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) বন্ধ করার সিদ্ধান্তের খবর প্রকাশের পর থেকে এ খাতে অস্থিরতা নেমে এসেছে। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আমানতকারীরা। ভাঁজ পড়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কপালে।
তারা বলছেন, দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় না এনে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত ভালো ফল বয়ে আনবে না। এতে অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকা পড়ে যাবে। মাঝখান দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন শেয়ারগ্রহীতারা।
এরই মধ্যে পুঁজিবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার দরে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কেউ এই শেয়ার কিনতে চাচ্ছে না। ফেসভ্যালুর অনেক নিচে নেমে এসেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার দর।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে এফএএস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, আভিভা ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং।
এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের শেয়ারদর গত সপ্তাহে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ কমেছে। সপ্তাহ শেষে কোম্পানিটির শেয়ারদর দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ৬০ পয়সায়, আগের সপ্তাহ শেষে ছিল ২ টাকা ৪০ পয়সা। এতে কোম্পানিটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাপ্তাহিক দরপতনের শীর্ষ তালিকায় উঠে এসেছে। ডিএসই সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
আলোচিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বিনিয়োগ রয়েছে, এমন এক ব্যবসায়ী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এটা একটি বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে আগামী দিনগুলোয় ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও খারাপ হতে থাকবে। কারণ অপরাধ করে যদি বিচারের আওতায় না আসতে হয়, তাহলে সবাই সেই পথেই পা বাড়াবে।
সেক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে বন্ধ না করে যাদের অবহেলা ও দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে তাদের বিচারের আওতায় আনার দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দৃষ্টি দেয়ার পরামর্শ দেন ওই ব্যবসায়ী।
তিনি বলেন, অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া দরকার। তাহলে আর কেউ এ ধরনের অনিয়ম করার সাহস পাবে না। অনিয়মের কারণে কোম্পানি বন্ধ করা যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নয়।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের আগে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা দরকার। কিন্তু সে ধরনের কোনো কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। অথচ প্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্যে দিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সুবিধাভোগীদের আরও সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এই প্রশ্ন একদিন জাতির সামনে ঠিকই ওঠে আসবে।
ওই ব্যবসায়ীর মতে, প্রতিষ্ঠানগুলোতে পুরোনো পরিচালকদের বাদ দিয়ে নতুন পরিচালক নিয়োগ দেয়া দরকার ছিল। প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা দরকার ছিল। খেলাপিরা আইনের ঊর্ধ্বে নন। তাদের আইনের আওতায় না এনে উল্টো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করায় দেশ এবং দেশের বাইরে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের রেটিং নিচে নেমে আসবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ না করে কীভাবে চালু করা যায় সরকারের উচিত সেদিকে দৃষ্টি দেয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারা, উচ্চ খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতিÑএই তিন সূচকের ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে। এরই মধ্যে গভর্নরের সম্মতি নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান অবসায়নে (লিকুইডিশন) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগে তথ্য পাঠানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো অবসায়নে সরকারের ৯ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হতে পারে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন, ২০২৩ অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আইনের ৭(১) ধারা অনুযায়ী, আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থি কার্যক্রম পরিচালনা, দায় পরিশোধে সম্পদের অপর্যাপ্ততা এবং মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থতার কারণে লাইসেন্স বাতিলের সুযোগ রয়েছে। ৭(২) ধারা অনুযায়ী, লাইসেন্স বাতিলের আগে ১৫ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিতে হয়। গত ২২ মে এসব প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেয়া হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সন্তোষজনক জবাব না আসায় গত ২১ আগস্ট এক বৈঠকে অবসায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘৯টি প্রতিষ্ঠান লিকুইডেট করার বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে মত দিয়েছে। আমরা এটা করছি শুধু আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য। তাদের স্বার্থই আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার।’
তবে দীর্ঘসময় ধরে এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা আটকে থাকায় আমানতকারীদের অনেকেই কষ্টে জীবনযাপন করছেন। এর মধ্যেই প্রতিষ্ঠানগুলো হঠাৎ অবসায়নের সিদ্ধান্তে টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন তারা।
পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারী মশিউর রহমান প্রতিষ্ঠানটিতে ১৮ লাখ টাকা জমা রেখেছিলেন। এই টাকা আটকে পড়ায় অভাব-অনটনের মধ্যে চলছে তার দিন। এত দিনে মাত্র ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা তুলতে পেরেছেন। এখন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে তার আমানতের কী হবে; তা নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান শেয়ার বিজকে বলেন, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় এগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এটা এখনও পর্যালোচনা পর্যায়ে রয়েছে। সরকারের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার পর প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে যা কিছু হবে, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করেই হবে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরাও বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তারা বলছেন, একসঙ্গে ৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়বেন। এতে তাদের পরিবারগুলোয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘দুর্বল ব্যাংকগুলো একীভূত হলেও কর্মীদের চাকরি যাবে না বলে আশস্ত করেছিলেন গভর্নর। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমন কোনো বক্তব্য দায়িত্বশীল কারও কাছ থেকে এখনও আসেনি। এগুলোকে বন্ধ করা হলে আমানতকারীদের স্বার্থ যেমন দেখতে হবে, তেমনি বিদ্যমান জনবলের বিষয়টিও মাথায় রাখা দরকার। তা না হলে একসঙ্গে অনেক কর্মী বেকার হবেন। এতে সামাজিক অস্থিরতা বাড়তে পারে।’
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রভাবশালী পরিচালক, ঋণখেলাপি কিংবা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ীরা এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দুরবস্থার জন্য দায়ী। তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার সিদ্ধান্তের খবর প্রকাশের পর থেকে সমালোচনা চলছে সামাজিক মাধ্যমেও।
সম্প্র্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম বিষয়টি নিয়ে নিজের ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেন। তিনি সেখানে লিখেনÑ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত না করে, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ঠিক হবে না। … ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সুবিধাভোগীদের আরও সুবিধা দেয়ার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওই কর্মকর্তা।
এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের এক বক্তব্যের সূত্র ধরে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে আমানত তোলার হিড়িক পড়ে। এরপর আবার যখন ব্যাংক একীভূতকরণের সংবাদ প্রকাশিত হয়, তখন থেকেই পাঁচটি ব্যাংকের স্বাভাবিক লেনদেন কার্যক্রমও স্থবির হয়ে আসতে শুরু করে। এখনও ব্যাংক খাতের সেই স্থবিরতা কাটেনি।