অশোক দত্ত : দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গণপরিবহন মাধ্যম রেলপথ ক্রমেই নাজুক হয়ে পড়ছে। একদিকে ইঞ্জিন ও বগির সংকট, অন্যদিকে জরাজীর্ণ লাইন, অব্যবস্থাপনা, জনবল স্বল্পতা এবং দুর্বল সিগন্যালিং ব্যবস্থার কারণে রেলসেবা নিয়ে মানুষের আস্থা তলানিতে নেমেছে। বর্তমানে দেশের ৪৩ জেলার মধ্যে ৩৯ জেলার রেললাইন ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। পর্যাপ্ত পাথর না থাকা, মাটি সরে যাওয়া, সিøপার ভাঙা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং পুরোনো অবকাঠামোর কারণে প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। এতে যাত্রী কমে যাচ্ছে।
রেলওয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার ৬৩ শতাংশই দুর্বল লাইন ও ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর কারণে। সিøপার ভাঙা, লাইনচ্যুতি, সিগন্যালিং ত্রুটি, লাইন বেঁকে যাওয়া এবং জনবল সংকটকে রেল দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে কর্তৃপক্ষ। প্রচলিত ম্যানুয়াল সিগন্যালিং ব্যবস্থাও বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। অনেক সময় স্টেশন মাস্টারের ভুলে একই লাইনে বিপরীতমুখী ট্রেন প্রবেশ করা, আবার পয়েন্টসম্যানের ভুলেও লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। অথচ আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগে আর্থিক সীমাবদ্ধতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রেলওয়ের বহরে বর্তমানে ২৯৭টি ইঞ্জিন থাকলেও এর অর্ধেকের বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ। কার্যক্ষম ইঞ্জিন রয়েছে মাত্র ১৪৭টি। অথচ প্রতিদিন ট্রেন চালাতে প্রয়োজন হয় অন্তত ২৬৯টি লোকোমোটিভ। বাস্তবে সরবরাহ করা যাচ্ছে গড়ে ১৯২টি ইঞ্জিন। ফলে দৈনিক প্রায় ৭৭টি ইঞ্জিন ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। অপরদিকে ১ হাজার ৭৮৮টি যাত্রীবাহী কোচের মধ্যে ৪৭ শতাংশই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেলপথ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান শেয়ার বিজকে বলেন, ইঞ্জিন এবং লাইনে অনেক সমস্যা আছে। ইঞ্জিন তো সের দরে কেনা জিনিস নয়। আজ অর্ডার দিলেই সেটা আসতে অন্তত আড়াই বছর সময় লাগবে। তাই পুরোনো ইঞ্জিনগুলো মেরামতের দিকেই জোর দিচ্ছি। তিনি জানান, মেরামতের জন্য দীর্ঘদিন অর্থ সংকট ছিল। তবে ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় বরাদ্দকৃত অর্থ দ্রুত ছাড় দেবে এবং অতিরিক্ত বরাদ্দ আগামী ডিসেম্বরে সম্পূরক বাজেটে পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
তিনি আরও জানান, লাইনের সিøপার ঠিক নেই, লাইন ঠিক নেই, পাথর নেই-সহ বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করেন এবং সমস্যাগুলো দেখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছয়টি টিম পাঠানো হয়েছিল। তাদের প্রতিবেদনের আলোকে যে যে জায়গায় ত্রুটি আছে সেই জায়গাগুলো জরুরি ভিত্তিতে পাথর দেয়া, সিøপার পরিবর্তন করা ত্রুটিপূর্ণ লাইন মেরামতের জন্যও অতিরিক্ত বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে এবং আমরা সম্মতিও পেয়ে গেছি। বরাদ্দবৃত টাকা পেয়ে গেলে ধাপে ধাপে অবস্থার উন্নতি হয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে রেলপথের দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৯৩ কিলোমিটার এবং রেললাইনের দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ৪৩৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে রয়েছে ১ হাজার ৩৩৪ কিলোমিটার রেলপথ (মিটার গেজ ১ হাজার ২৯৯ কিমি, ডুয়াল গেজ ৩৪ দশমিক ৮৯ কিমি)। পশ্চিমাঞ্চলে রেলপথ ১ হাজার ৭৫৯ কিলোমিটার, যেখানে রয়েছে ৩৮১ কিমি মিটার গেজ, ৮৭৯ দশমিক ৮৫ কিমি ব্রড গেজ এবং ৪৯৮ দশমিক ৮১ কিমি ডুয়াল গেজ।
রেললাইনের দৈর্ঘ্য অনুযায়ী পূর্বাঞ্চলে ২ হাজার ১৫১ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার এবং পশ্চিমাঞ্চলে ২ হাজার ২৮৬ দশমিক ৬১ কিলোমিটার লাইন রয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি লাইন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে দেশে ৩১৫টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। গত ১৫ বছরে নতুন ট্রেন যোগ হয়েছে ১৪৩টি। তবে নতুন রেলপথ নির্মিত হয়েছে মাত্র ৮৪৩ কিলোমিটার। একই সময়ে মেরামত হয়েছে ১ হাজার ৩৯১ কিলোমিটার লাইন, যা মোট নেটওয়ার্কের তুলনায় অপ্রতুল। নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ হয়েছে ১৪৬টি, পুরোনো ভবন পুনর্নির্মাণ ২৭৩টি, নতুন সেতু নির্মিত হয়েছে ১ হাজার ৩৭টি এবং সংস্কার হয়েছে ৭৯৪টি। কিন্তু টেকসই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দিতে পারেনি।
দেশজুড়ে সিঙ্গেল লাইনের ওপর নির্ভরশীলতা যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-জয়দেবপুর ও যশোর-আব্দুলপুর ছাড়া অধিকাংশ রুটেই এখনও ডাবল লাইন হয়নি। ফলে প্রতিদিন শিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টিকিট কালোবাজারি, বন্ধ হয়ে যাওয়া স্টেশন, জরাজীর্ণ কারখানা ও জনবল সংকট। ফলে যাত্রীসেবার মান আস্তে আস্তে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
রেলওয়ের প্রয়োজনীয় জনবল ৪৭ হাজার ৬০০ হলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ২৪ হাজার জন। এই বিশাল ঘাটতির কারণে রক্ষণাবেক্ষণ ও দৈনন্দিন রেল পরিচালনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
বুয়েটের সাবেক পরিচালক ও গণপরিবহন বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, রেলে এখন একমুখী উন্নয়ন হচ্ছে। নতুন লোকোমোটিভ ও কোচ কেনা হলেও ঝুঁকিপূর্ণ লাইন ও সেতুর মেরামতে তেমন উদ্যোগ নেই। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি যেমন বাড়ছে, তেমনি যাত্রীসেবার মানও উন্নত হচ্ছে না।
তিনি মনে করেন, নতুন প্রকল্প গ্রহণের পাশাপাশি বিদ্যমান রেললাইন, সেতু সংস্কার ও আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা চালু করাই রেলকে নিরাপদ ও টেকসই করার প্রথম শর্ত। আর্থিক সংকট কাটিয়ে পরিকল্পিত বিনিয়োগ ছাড়া রেলকে জনগণের আস্থার পরিবহন হিসেবে পুনর্গঠন সম্ভব নয়।
রেলযাত্রার প্রতি এখনও মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিদিন লাখো মানুষ ট্রেনে চলাচল করেন। কিন্তু অব্যবস্থাপনা, শিডিউল বিপর্যয়, দুর্ঘটনা ও ভোগান্তি যাত্রীদের ভেতর আস্থা নষ্ট করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রেলকে টেকসই ও নিরাপদ করতে হলে জরাজীর্ণ লাইন, সেতু ও সিগন্যালিং ব্যবস্থা সংস্কারের পাশাপাশি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও দক্ষ জনবল নিয়োগ অপরিহার্য। সরকারি বরাদ্দ যথাসময়ে বাস্তবায়িত হলে এবং পরিকল্পিত বিনিয়োগ বাড়ানো গেলে রেল আবারও জনগণের আস্থার প্রধান গণপরিবহন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে রেলওয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে জানান, দ্রুত ২১টি ইঞ্জিন মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি মিটারগেজ এবং পাঁচটি ব্রডগেজ ইঞ্জিন রয়েছে। তিনি বলেন, বাজেট ঘাটতি ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সংগ্রহে জটিলতার কারণে আমরা সমস্যায় পড়েছি। তবে এর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে আরও বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন দ্রুত অর্থ ছাড় হলে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যেই লোকোমোটিভগুলো মেরামত করে রেলবহরে যুক্ত করা সম্ভব হবে।

Discussion about this post