মো. আরিফুল ইসলাম : আইডিএলসি বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ভূমিকা এবং সাফল্য কেবল আর্থিক সূচক দ্বারাই পরিমাপ করা হয়, খাতসংশ্লিষ্ট মানবসম্পদের ভূমিকা উহ্য থাকে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানের সাফল্য বা ব্যর্থতা অনেকাংশে এর মানবসম্পদের ওপরই নির্ভর করে থাকে। কর্মী দক্ষতা, কাজের উন্নত পরিবেশ ও কর্মপরিবেশে ইতিবাচক সংস্কৃতি ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানই টেকসইভাবে অগ্রসর হতে পারে না। এই মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় যেমন চ্যালেঞ্জ আছে, তেমনি আছে অনন্য সম্ভাবনা। এই দিকগুলোতে আমাদের মনোনিবেশ বাড়ানো জরুরি, অন্যথায় দেশের ব্যাংক খাতে সম্ভাবনাময় মানবসম্পদের বড় একটা অংশ নিজেদের সক্ষমতা বিকাশে পিছিয়ে থাকবে।
বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, বেতন-বোনাস অর্থাৎ আর্থিক সুবিধা ও প্রণোদনা বাড়িয়ে দিলেই হয়তো কর্মীদের অনুপ্রাণিত করা সম্ভব। কিন্তু দেখা যায় যে, দক্ষ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মীরা আর্থিক সুবিধার পাশাপাশি সামাজিক পরিচয়ের বিকাশ ও নেতৃত্বের সুযোগকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। পাশাপাশি, কর্মপরিবেশে নিরাপত্তা, নিরপেক্ষতা ও সমান সুযোগ পাওয়ার নিশ্চয়তা, পারফর্ম্যান্সের ভিত্তিতে উপযুক্ত রিওয়ার্ড বা পুরস্কার প্রাপ্তির সুযোগ— এগুলোর বিবেচনায় তারা দীর্ঘমেয়াদে ক্যারিয়ার গড়ার সহায়ক প্রতিষ্ঠান বেছে নেন।
এক্ষেত্রে কিছু সর্বজন স্বীকৃত বিষয় আছে যার কার্যকর সমাধানে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়, তা হল প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের কর্মভারের সুষ্ঠু বণ্টন, ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স অর্থাৎ পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য নিশ্চিত করা ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ দেয়া। চলতি বছরের শুরুতে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বেশির ভাগ ব্যাংকের কর্মচারীরা অতিরিক্ত কাজ ও দীর্ঘ কর্মঘণ্টার কারণে ব্যক্তিগত জীবন ও পারিবারিক দায়িত্বের মাঝে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারছেন না। এই সমস্যা শুধু কর্মীদের প্রোডাক্টিভিটি কমে যাওয়া নয়, বরং কাজের মান হারানো ও গ্রাহক সেবায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলার পেছনেও দায়ী।
প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন সুযোগের অভাবেও অনেক প্রতিষ্ঠানে ভালো ভালো কর্মীরা কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এ প্রসঙ্গে ২০২৪ সালের একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের সুযোগ এবং ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগের অনিশ্চয়তা দেশের প্রাইভেট ব্যাংকিং সেক্টরে কর্মচারীদের অসন্তুষ্টির অন্যতম কারণ। তাছাড়া নতুন প্রজন্মের কর্মীরা যারা এই খাতে প্রবেশ করছে তাদের কাছে কর্মঘণ্টার স্বাচ্ছন্দ্য, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, এমনকি হাইব্রিড ওয়ার্ক মডেলে কাজের সুযোগও গুরুত্ব পাচ্ছে। এই প্রত্যাশাগুলো পূরণ করতে না পারলে তরুণরা দ্রুতই চাকরি পরিবর্তনের সুযোগ খোঁজেন, যা প্রতিষ্ঠানের জন্যও অনাকাঙ্ক্ষিত ও অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই তরুণ মানবসম্পদ ধরে রাখার ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আরো সচেতন ও সংবেদনশীল হওয়াও এখন সময়ের দাবি।
ব্যাংকিং খাতে আধুনিক মানবসম্পদ নীতি ও সাংগঠনিক সংস্কারে বাস্তবমুখী ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সর্বপ্রথমে বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বেতন কাঠামো নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি, কর্মীদের পারফর্ম্যান্স ভিত্তিক বোনাস ও পুরস্কার ব্যবস্থাও আরও স্বচ্ছ ও ন্যায্য হতে হবে। শুধু উচ্চপদে নয়, মাঝারি ও নিম্ন পর্যায়ের কর্মীদের ক্যারিয়ার গ্রোথকেও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার স্পষ্ট প্রতিফলন থাকতে হবে।
আমাদের ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ বিভাগকে আরও সময়ানুগ ও সক্রিয় করা প্রয়োজন, যার আওতায় নিয়মিত কর্মশালা, টেকনিক্যাল ও নন-টেকনিক্যাল স্কিল উন্নয়ন, লিডারশিপ ট্রেনিং, মেন্টরিং আয়োজিত হবে। বিশেষভাবে, ফিনটেক ও ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে প্রশিক্ষণ ও তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণও একান্ত জরুরি।
প্রতিষ্ঠানে কাজের পরিবেশ ও ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স উন্নয়নের লক্ষ্যে পর্যাপ্ত ছুটি, ওয়ার্ক ফরম্যাটে বিকল্প পন্থা, যেমন হাইব্রিড কাজের সুযোগ তৈরি, ফ্লেক্সিবল ওয়ার্ক আওয়ার তৈরি এবং এমপ্লয়ি এনগেজমেন্ট অ্যাক্টিভিটির মতো বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনতে হবে। কর্মীদের নিয়মিত কর্মভার যাচাই করা এবং এক্ষেত্রে প্রোডাক্টিভিটি মেজারমেন্ট এবং মনিটরিং টুলস ব্যবহার করার মাধ্যমে সুষ্ঠু এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে, যা কর্মভারের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিতেও সাহায্য করবে। যেকোনো নতুন, ভালো সুযোগ তৈরি হলে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কর্মরতদের অগ্রাধিকার দেয়া ও তাদের সম্ভাবনা যাচাই করা এক্ষেত্রে আরেকটি ভালো চর্চা হতে পারে, যা কর্মীদের মধ্যেও ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করে।
এছাড়া বিভিন্ন এমপ্লয়ি সাপোর্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও সহানুভূতির সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্যোগও দরকার। ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ ও ব্যবহারের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। নতুন প্রজন্মের কর্মীদের জন্য মানানসই আরও উন্নত রিমোট কাজের প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে। এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো দক্ষতা ও প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানোর ক্ষেত্রে কতটুকু ভূমিকা রাখছে, তার পরিমাণগত ও গুণগত মূল্যায়ন করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে এ ধরনের পরিবর্তন কার্যকরী হওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উভয় পর্যায় থেকেই সমান দায়িত্বশীলতা দেখানো প্রয়োজন।
আইডিএলসি ফাইন্যান্সের মানবসম্পদ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে আমি মনে করি, অন্তত ব্যাংক খাতের কার্য ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াতে কর্মীরাই হলো প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। যখন কর্মীরা সমর্থিত ও মূল্যায়িত বোধ করে, কেবল তখনই প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক অবস্থানের দিক থেকেও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কর্মীরা নিজ প্রতিষ্ঠান নিয়ে আরও আত্মবিশ্বাসী হন, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটিও চাকরির বাজারে রীতিমতো ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে আগামীর দক্ষ মানবসম্পদদের আকৃষ্ট করতে পারে। কর্মীদের মনোবল বাড়লে গ্রাহকসেবার মানও উন্নত হবে, যার মাধ্যমে ব্যাংকের পারফরম্যান্সে উন্নতিসহ পুরো দেশের অর্থনীতিতে আরও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ও চিফ হিউম্যান রিসোর্সেস অফিসার (ভারপ্রাপ্ত)
প্রিন্ট করুন










Discussion about this post