বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের শুরু থেকে যা ঘটেছে এবং ঘটছে, সে বিষয়ে সবাই অবগত। দেশে যারা আছেন, তাদের এ ঘটনাবলির দুঃসহ, মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাই আছে। ছাত্র-জনতার সাম্প্রতিক লড়াইয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শামিল হয়েছিল কবিতা, গান, র্যাপ, পোস্টার, কার্টুন আর গ্রাফিতি। স্লোগান রাজনীতির মাঠ থেকে উচ্চকিত সুরধ্বনি। স্লোগান রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা আর ক্ষোভের ভাষা। সময়োপযোগী একটা স্লোগান জটিল রাজনৈতিক ভাবকে সহজ ভাষায় মানুষের মাথায় গেঁথে দিতে কাজ করতে পারে মোক্ষম অস্ত্রের। স্লোগান শত্রু-মিত্র চিনতে শেখায়। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় আমরা স্লোগানের ভাষায় নতুনত্বের প্রকাশ দেখি, যা সেই সময়ে মাঠে আন্দোলনে শামিল সবাইকে উদ্দীপ্ত করেছে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। জুলাই অভ্যুত্থানকে পটভূমি করে কবিতা রচিত হয়েছে অসংখ্য। নতুন নতুন গান তেমন যথেষ্ট সংখ্যক শোনা যায়নি। জুলাই অভ্যুত্থানের পটভূমিতে গল্প উপন্যাসও যথেষ্ট সংখ্যক নয় এখন পর্যন্ত।
৫ আগস্ট ২০২৪। স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী দুঃশাসনের অবসান ঘটেছিল সেদিন। সবাই ভয় মুক্ত হয়ে বাসাবাড়ি থেকে বেরিয়ে নেমে এসেছিল রাজপথে। বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিল নিসংকোচে, নির্ভয়ে। এমন একটি দিনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ অনেক দিন ধরে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল। সৃষ্টিকর্তা কতো বড়ো দয়াময়। মজলুম মানুষের হৃদয়ে আকুতি, তাদের চাওয়া তিনি পূরণ করেছিলেন অত্যাচারী, নির্মম, বর্বর স্বৈরাচারী শাসকের ভয়ানক পতনের মাধ্যমে। কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে তীব্র গণ-অভ্যুত্থানে রূপ পাওয়া যে জুলাই বদলে দিয়েছে এই ভূখণ্ডের ইতিহাস, বাংলাদেশের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, বিস্ময়ে হতবাক হয়েছে গোটা পৃথিবী। বয়স, শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে এক অনন্য বিজয় অর্জিত হয়েছে। এই গণ-অভ্যুত্থান হয়ে উঠেছে সর্বস্তরের মানুষের শক্তি, প্রতিরোধ ও আকাক্সক্ষার রঙে রঙিন। ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী এই অভূতপূর্ব আন্দোলনের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে গিয়ে অগণিত তরতাজা টগবগে তরুণ, তরুণী, যুবক, কিশোর, নিষ্পাপ শিশু, বয়োবৃদ্ধ নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটাতে নিজের মূল্যবান প্রাণ দিয়ে তারা অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। ইতিহাসের পাতায় তাদের আত্মত্যাগের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এছাড়া অগণিত মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। আত্মত্যাগী ওইসব মানুষগুলোর কথা আমরা কোনোভাবেই ভুলতে পারব না। জুলাই বিপ্লবের বাস্তব পটভূমিকায় লেখা একগুচ্ছ গল্পের সংকলন ‘দ্রোহকাল’। প্রতিটি গল্পেই চব্বিশের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময়কার ভয়ংকর বাস্তবতা ফুটে উঠেছে অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী হয়ে। গ্রন্থটি উৎসর্গ হয়েছে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা দুঃসহ স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশকে নতুন পথের দিশা দিতে চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে আত্মদানকারী সব শহিদ এবং পঙ্গুত্ব বরণকারী অগণিত নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী সবাইকে।
মোট ৯টি গল্প রয়েছে ‘দ্রোহকাল’ বইটিতে। গল্পগুলো হলো, আমরা তোমাদের ভুলব না, একজন শেফালীর গল্প, বিদ্রোহী কন্যা, গ্রাফিতির ভাষা, দ্রোহকাল, নয়নতারা ও কয়েকটি বুলেটের খোসা, দুঃস্বপ্নের প্রহর, নতুন এক বাংলাদেশে রাজিব সাহেব ও বেদনার ক্যানভাস।
প্রতিটি গল্পেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়কার বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন গল্পকার রেজাউল করিম খোকন। সহজ সাবলীল বর্ণনায় পাঠককে গল্পের মধ্যে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন বলা যায়। রেজাউল করিম খোকন জুলাই অভ্যুত্থানের সময়কার বাস্তব চিত্র নিজের চোখে দেখেছেন। অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, নিজের চোখে দেখা বাস্তব চরিত্রগুলোকে গল্পে অত্যন্ত নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানে আত্মদানকারী শহিদ নাঈমা, নাফিসা, সামিরকে নিয়ে লেখা গল্প আমরা তোমাদের ভুলব না, বিদ্রোহী কন্যা, বেদনার ক্যানভাসের কথা বলা যায়। দ্রোহকাল গল্পে একটি পরিবারের নৈমিত্তিক জীবনে জুলাই অভ্যুত্থান কীভাবে প্রভাব ফেলেছিল সেটা আন্তরিকভাবে তুলে ধরেছেন। যেন গল্পকার তার নিজের একান্ত ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করছেন বলে মনে হয়েছে। একইভাবে গ্রাফিতির ভাষা, একজন শেফালীর গল্প, নতুন এক বাংলাদেশে রাজিব সাহেব এবং দুঃস্বপ্নের প্রহর গল্পগুলোর চরিত্র এবং বর্ণিত ঘটনাবলি খুবই চেনাজানা মনে হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পটভূমিতে আমাদের চারপাশের মানুষের গল্প উঠে এসেছে প্রতিটি গল্পে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে আরও অসংখ্য গল্প, উপন্যাস গ্রন্থ প্রকাশিত হবে আগামীদিনে। তবে এ ক্ষেত্রে আলোচ্য গল্পগ্রন্থ ‘দ্রোহকাল’ একটি অনবদ্য সংযোজন নিঃসন্দেহে। গ্রন্থটির প্রকাশক পাপুল। ১১২ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ৩০০ টাকা। বইটির অনুপম প্রচ্ছদ ডিজাইন করেছেন রজত। বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
ইমরান গালিব