আসাদুজ্জামান রাসেল, রাজশাহী : বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আলু উৎপাদনকারী অঞ্চল রাজশাহীতে নতুন মৌসুমের আলু বাজারে উঠতে না উঠতেই পুরোনো আলুর বাজার ধসে পড়েছে। হিমাগার পর্যায়ে পুরোনো আলুর দাম গত এক সপ্তাহে কেজিতে ৮-১০ টাকা কমে ১১ টাকায় নেমেছে। ফলে হিমাগারে মজুত লাখ লাখ বস্তা পুরোনো আলু নিয়ে বড় ধরনের লোকসানে পড়েছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। অনেকে বলছেন, নতুন আলু পুরোনো আলুর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে।
রাজশাহী অঞ্চলে ৩৯টি হিমাগার রয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত শনিবার পর্যন্ত এসব হিমাগারে ৪৪ হাজার ১১০ মেট্রিক টন পুরোনো আলু মজুত ছিল। কিন্তু নতুন আলু বাজারে আসার পর থেকে ক্রেতারা হিমাগারমুখী হয়নি। বেচাকেনা প্রায় বন্ধ।
রাজশাহীর সরকার কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক রুহুল আমিন শেয়ার বিজকে জানান, তাদের হিমাগারে এখনো ১৩ হাজার ৫০০ বস্তা পুরোনো আলু অবিক্রীত আছে। কয়েক দিন আগেও দাম ছিল কেজিপ্রতি ১৯ টাকা, এখন ক্রেতা না থাকায় দাম নেমেছে ১১ টাকায়। গত মঙ্গলবার থেকে একজন ক্রেতাও আসেনি।
একই অবস্থা উপজেলা তানোরের রহমান ব্রাদার্স কোল্ড স্টোরেজসহ অন্যান্য হিমাগারে।
মোহনপুরের ব্যবসায়ী লিমন সম্প্রতি রহমান ব্রাদার্স থেকে ৫০০ বস্তা পুরোনো আলু কিনেছেন কেজিতে মাত্র ১১ টাকা দরে। লিমন জানান, গত বছর আমি ১১৫ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলাম। উৎপাদন খরচ পড়েছিল কেজিতে ২২-২৫ টাকা। বিক্রি করেছি ১২-১৪ টাকায়। এত লোকসানের পর এবার চাষ করিনি, ব্যবসা শুরু করেছি। কিন্তু এখন ব্যবসাতেও লোকসানের শঙ্কা।
তানোর উপজেলার কলমা ইউনিয়নের চাষি শাথিলের অবস্থা আরো করুণ। তিনি এবার হিমাগারে ১ হাজার ৫০০ বস্তা আলু রেখেছিলেন। উৎপাদন খরচ, হিমাগার ভাড়া, পরিবহন ও বস্তার খরচ মিলিয়ে প্রতি কেজিতে খরচ দাঁড়িয়েছে ৩৫ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১১ টাকায়, কেজিতে ২৪ টাকা লোকসান। গত সোমবার বাধ্য হয়ে ২০০ বস্তা ১৪ টাকায় বিক্রি করেছেন। মঙ্গলবার দাম আরো কমেছে। শাথিল বলেন, নতুন আলু এসে পুরোনো আলুর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে।
রাজশাহী বরেন্দ ভূমির উর্বর জমিতে আলু চাষের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। সত্তরের দশক থেকেই এ অঞ্চল দেশের আলু উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয়। গত ২০২৪-২৫ মৌসুমে রাজশাহী জেলায় ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১০ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে, জেলার বার্ষিক আলুর চাহিদা মাত্র ১ লাখ ১৩ হাজার টন। অর্থাৎ উৎপাদন চাহিদার ৯ গুণের বেশি। এ কারণে প্রতি বছরই দামের ওঠানামা হয়।
অতিরিক্ত উৎপাদনের এ চক্রেই কৃষকরা প্রতি বছর লোকসানের শিকার হন। অনেকে উচ্চ দামের আশায় হিমাগারে আলু মজুত করেন। কিন্তু নতুন মৌসুম শুরু হলে পুরোনো আলুর চাহিদা প্রায় শূন্য হয়ে যায়।
গত আগস্ট মাসে সরকার হিমাগার পর্যায়ে আলুর ন্যূনতম দাম ২২ টাকা নির্ধারণ করে এবং ৫০ হাজার মেট্রিক টন আলু কেনার ঘোষণা দেয়। কৃষকরা সেই আশায় হিমাগারে আলু রেখে দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি, কোনো আলু কেনাও হয়নি। আলুচাষি ও ব্যবসায়ী এ ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় বিভ্রান্ত। তারা জানান, কর্তৃপক্ষের উচিত বিষয়টি অতি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা।
রাজশাহী কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহানা আখতার জাহান বলেন, সরকার মৌখিকভাবে ২২ টাকা দরে আলু কেনার কথা বলেছিল। কিন্তু কোনো লিখিত নির্দেশনা আসেনি। বাজারে যেসব নতুন আলু এসেছে, সেগুলো এখনো পরিপক্ব হয়নি। চাষিরা বেশি দামের লোভে আগেভাগে তুলে বাজারে নিয়ে আসছেন। এতে পুরোনো আলুর চাহিদা কমে গেছে। বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, দেশে প্রায় ৪০০টি হিমাগারে এখনো লাখ লাখ টন পুরোনো আলু মজুত আছে। সরকার যদি ঘোষিত দামে না কেনে, তাহলে কৃষক ও হিমাগার মালিক উভয়ই বড় লোকসানে পড়বে।
হিমাগার ও পাইকারি বাজারে পুরোনো আলুর দাম ধস নামলেও খুচরা বাজারে তার প্রভাব এখনো তেমন পড়েনি। তবে রাজশাহীর সাহেব বাজার, নওদাপাড়া বাজার এবং খড়খড়ি বাইপাস বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে গত সপ্তাহে পুরোনো আলু বিক্রি হয়েছে কেজিতে ২৫-৩০ টাকায়। অন্যদিকে নতুন আলুর দাম আকাশছোঁয়া, দেশি লাল আলু ৯০-১০০ টাকা এবং সাদা আলু ৫০-৭০ টাকা!
বিক্রেতারা বলছেন, নতুন আলুর স্বাদ ভালো এবং দেখতে সুন্দর হওয়ায় ক্রেতারা সেটাই কিনছেন। ফলে পুরোনো আলুর চাহিদা কম। ভোক্তারা অবশ্য স্বস্তিতে আছেন, পুরোনো আলু এখনো সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু দু-এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন আলুর সরবরাহ বাড়লে পুরোনো আলুর দাম আরও কমতে পারে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহীর মতো একই চিত্র মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, পঞ্চগড়সহ অন্যান্য আলু উৎপাদনকারী জেলায়। মুন্সীগঞ্জে হিমাগারে পুরোনো আলুর দাম নেমেছে ১০-১২ টাকায়। বগুড়ায়ও একই অবস্থা। কৃষকরা বলছেন, দেশে আলুর উৎপাদন বেশি হলেও রপ্তানি বা প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প না থাকায় প্রতি বছর এই সংকট দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আলু রপ্তানি বাড়াতে হবে। যেহেতু ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি আলুর চাহিদা রয়েছে, তাই সেদিকে লক্ষ রেখে রপ্তানি প্রক্রিয়া আরো জোরদার করা যেতে পারে।
অন্যদিকে, প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তুলে সেখানে চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, আলুর গুঁড়া ইত্যাদি তৈরির কারখানা স্থাপন করা যেতে পারে। সরকারি ক্রয় কার্যকর করা এবং বাফার স্টক তৈরি করতে হবে এবং প্রান্তিক আলু চাষি, ব্যবসায়ী সবাইকে সার্বিক সহযোগিতা করতে হবে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বলেন, আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি যেন তারা অতিরিক্ত আলু চাষ না করেন এবং বিকল্প ফসলের দিকে ঝুঁকেন। ধান, পেঁয়াজ, রসুন, ভুট্টা ইত্যাদি চাষ লাভজনক হতে পারে।
রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে দেখা যায়, অনেক কৃষক আলু চাষ ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে ব্যবসায় নেমেছেন, আবার আলু চাষের শ্রমিকরা অন্যদিকে ভিন্ন কাজ করছেন। শাথিলের মতো যারা হিমাগারে আলু রেখেছেন, তাদের রাতে ঘুম হচ্ছে না। অনেকে ব্যাংক ও মহাজনের ঋণের চাপে আছেন। এক চাষি বলেন, এবার যদি লোকসান হয়, তাহলে পরিবার নিয়ে রাস্তায় বসতে হবে। হিমাগার মালিকরাও বিপাকে। বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারী বেতন, রক্ষণাবেক্ষণ সব মিলিয়ে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা খরচ। আলু না বিক্রি হলে তারাও লোকসানে পড়বেন।
রাজশাহীর আলু বাজার এখন এক গভীর সংকটের মুখে। নতুন আলুর আগমনে পুরোনো আলু নিয়ে কৃষক-ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তা চরমে। তাই দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকদের জীবিকার স্বার্থে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
প্রিন্ট করুন










Discussion about this post