অশোক দত্ত : বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জর্জরিত হয়ে খেলাপি ঋণের বোঝা তলায় পড়ে যাওয়া দেশের ইসলামি ধারার পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শরিয়াহভিত্তিক এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক মিলে গঠন করা হবে একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নতুন ইসলামিক ব্যাংক। একীভূত ব্যাংকের সম্ভাব্য নাম হতে পারে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’। এজন্য প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
এর মধ্যে মূলধন হিসেবে সরকার দেবে ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা আসবে আমানত বিমা তহবিল এবং এসব ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকে শেয়ারে রূপান্তরের মাধ্যমে। আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শেষ করার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে সময়ভিত্তিক কর্মকৌশল চূড়ান্ত করতে গঠন করা হয়েছে একটি বিশেষ ওয়ার্কিং কমিটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহাম্মদকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ রাশেদুল আমিন ও উপসচিব ফরিদ আহমেদ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দুই যুগ্ম সচিব শেখ ফরিদ ও মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক রেজল্যুশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জহির হোসেন এবং একই বিভাগের দুই অতিরিক্ত পরিচালক কাজী আরিফ উজ জামান ও মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৭৭ শতাংশ। এর ফলে ব্যাংকগুলোর নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৭৪ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই অস্বাভাবিক খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর জন্য ধ্বংসাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করেছে।
একীভূতকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে আলাদা বৈঠক করেছে পাঁচ ব্যাংকের সঙ্গে। এর মধ্যে তিনটি ব্যাংক একীভূতকরণে সম্মতি দিলেও এক্সিম ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক আপত্তি জানিয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, যদি তারা পর্যাপ্ত মূলধন জোগাড় করে ব্যবসা চালাতে সক্ষম হয়, তবে তাদের একীভূতকরণের আওতায় আনা হবে না।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বলছে, ব্যাংক একীভূতকরণের মতো সিদ্ধান্ত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে বিবেচিত। তালিকাভুক্ত কোম্পানির বড় ধরনের পরিবর্তনের তথ্য বিনিয়োগকারীদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের জানায়নি। এদিকে বাজারে খবর ছড়িয়ে পড়ায় ব্যাংকগুলোর শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে।
এসব প্রসঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে অর্থউপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ব্যাংক একীভূতকরণের ফলে আমানতকারীদের কোনো ক্ষতি হবে না। ব্যাংক একীভূত হলেও আমানতকারীদের অর্থ নিরাপদ থাকবে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
পাশাপাশি তিনি জানান, শুধু পাঁচ ইসলামি ব্যাংক নয়, ২২টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) একীভূত করার বিষয়েও ভাবছে সরকার।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, প্রথম দিন থেকেই বলে আসছি, একীভূত হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তবে অন্যান্য ব্যাংকের কিছু পরিচালনা পর্ষদ এখনও দ্বিধায় রয়েছে।
দেড় বছর আগে নেয়া একীভূতকরণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি। এখন আবার নতুন উদ্যোগ নেয়া হলেও সামনে জাতীয় নির্বাচন থাকায় এ প্রক্রিয়া কতটা টেকসই হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরেও।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শুধু একীভূতকরণই সমাধান নয়, বরং কঠোর তদারকি ও দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা না গেলে এই নতুন ব্যাংকও আগের মতো সমস্যায় পড়বে। তবুও আপাতত সরকারের প্রধান লক্ষ্য হলো, বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণের বোঝা থেকে ব্যাংক খাতকে রক্ষা করা এবং আমানতকারীদের আস্থা বজায় রাখা।