মীর আনিস : পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ও তার অধীন প্রতিষ্ঠান পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পিবিএস) মধ্যে পুরোনো সংকট তীব্র হচ্ছে। হাসিনা সরকারের পতন হলেও আরইবি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র থামেনি। বরং এটি আরও ঘনীভূত হয়েছে। গতকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য গণছুটির ঘোষণা দিয়েছেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রাষ্ট্রবিরোধী এ ষড়যন্ত্রে ইন্ধন জোগাচ্ছে প্রতিবেশী একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা। জানা গেছে, শতকোটি টাকার অধিক তহবিল নিয়ে পরিকল্পিতভাবে দেশি-বিদেশি শক্তি রাষ্ট্রের জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করার চেষ্টায় উঠেপড়ে লেগেছে। শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে উঠে আসে এমন চাঞ্চল্যকর বেশকিছু তথ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩ সালে পতিত সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও সামিট গ্রুপসহ আরও কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপ ১০০ কোটি টাকার তহবিল দিয়েছিলেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে। এছাড়া সমিতি বিভিন্নভাবে চাঁদা তুলে আরও ৫০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছিল। এই ১৫০ কোটি টাকা দিয়ে তখন আন্দোলন করে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে আলাদা করার পরিকল্পনা করেছিল ওই মহলটি।
এদিকে হাসিনা সরকারের পতন হলেও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়ে খেলছেন বিপু ও সামিট গং। তারা এ ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে সরকারকে চাপে রাখতে চাচ্ছেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আরইবির একটি সূত্র জানিয়েছে, সারাদেশে গণছুটির ঘোষণা দিলেও মাত্র আটটি সমিতিতে এটি অল্পপরিসরে কার্যকর হয়েছে। সারাদেশে পল্লী বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সেবা কার্যকর আছে। সমিতিগুলো নিয়মিতভাবে সব ধরনের যোগাযোগ করে যাচ্ছে।
এই দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আব্দুল হাকিম এজিএম (ওঅ্যান্ডএম) ও সমন্বয়ক, মো. আসাদুজ্জামান ভূইয়া ডিজিএম ও সমন্বয়ক এবং প্রকৌশলী রাজন কুমার দাস এজিএম (ইঅ্যান্ডসি) ও সমন্বয়ক, পল্লী বিদ্যুৎ অ্যাসোসিয়েশনের সহ-দপ্তর সম্পাদক অঞ্জু রানী মালাকারসহ প্রায় ৫০ জন। তারা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে সারাদেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন। এছাড়া পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের কতিপয় আমলা ও স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ী এই আন্দোলনে মদত জোগাচ্ছেন। অর্থকড়ি দিয়ে আন্দোলনে কর্মীদের ভাড়া করে নিয়ে আসছেন। আন্দোলনে নেতাদের বড় অঙ্কের অর্থ দিয়ে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত করতে প্রলুব্ধ করছেন।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান শেয়ার বিজকে বলেন, পল্লী বিদ্যুতের সমস্যাগুলোর সমাধানে আমরা দুটি কমিটি করেছিলাম। তাদের জমা দেয়া প্রতিবেদনে তিন হাজার কর্মীর চাকরি পুনর্বহালের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে থেকে আমরা প্রথম পর্যায়ে এক হাজার কর্মীর চাকরি পুনর্বহালের উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু এমন সময়েই কেন গণছুটির কর্মসূচিতে যেতে হবে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বেতন বেসরকারি খাতের বেতনকাঠামো অনুযায়ী। সে হিসেবে সমিতির কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বেতন আরইবির কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের চেয়ে অনেক বেশি। সমিতির একজন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার চাকরির শুরুতে ৬০ হাজার টাকা বেতন পান। অন্যদিকে আরইবির একজন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়র বেতন পান ৪০-৪৫ হাজার টাকা। একজন জিএমের বেতন দেড় লাখ টাকা। জিএম লেভেলের একজন আরইবির কর্মকর্তার বেতন ৮০ হাজার টাকার বেশি নয়। এ বিষয়ে আরইবির একজন কর্মকর্তা বলেন, আর্থিক কোনো সমস্যা নেই। সমস্যাটা সামাজিক। স্ট্যাটাস সমস্যা। এ কারণে তারা আরইবির সঙ্গে একীভূত হতে চায় অথবা কোম্পানির নামে থাকতে চায়।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, সমিতির ৪০ হাজার কর্মচারী ও কর্মকর্তা। তাদের রাজস্ব খাতে আনা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। সরকার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিলে নতুন সমস্যা হবে। তাদের তখন বেতন কমে যাবে। তিনি বলেন, ৮০টি সমিতির মধ্যে মাত্র ১১টি লাভজনক। বাকিগুলো লোকসানে রয়েছে। লোকসানি সমিতি দিয়ে কোম্পানি গড়লে তা লাটে উঠবে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আরইবির তিন কোটি গ্রাহক। এদের মধ্যে লাইফলাইন গ্রাহক (নিম্নবিত্ত) দেড় কোটি। এই দেড় কোটি গ্রাহক দুটি লাইট ও একটি ফ্যান ব্যবহার করে মাসে ২০০ টাকার মধ্যে বিল পরিশোধ করেন। এই দেড় কোটি গ্রাহকসহ তিন কোটি গ্রাহকের সেবার মান ঠিক রাখার পাশাপাশি অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে আরইবি নিয়মিত সবকিছু মনিটরিং করে। পাশাপাশি সবকিছু অডিট হয়। এসব মোটেই পছন্দ নয় সমিতির। তারা স্বাধীনতা চায়। অনিয়ম করে অর্থ উপার্জন করতে চায়, যার কারণে তারা আন্দোলন করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, আমরা প্রত্যাশা করছি এ ধরনের অস্থিরতা দ্রুত নিরসন হবে। এ ধরনের কার্যক্রমের কারণে মানুষের দুর্দশা ও ভোগান্তি বাড়ছে। আমরা আশা করব কর্মকর্তারা বিষয়টি অনুধাবন করবেন।
অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করে শেয়ার বিজ। তবে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু পলাতক থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তাছাড়া সামিট গ্রুপের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অনেকেই দেশের বাইরে থাকায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সামিট গ্রুপের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা মহসেনার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি।