সাদিয়া সুলতানা : বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে নারী উদ্যোক্তা সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। একসময় নারীরা ঘরের বাইরে কাজ করাকে সীমাবদ্ধ মনে করলেও বর্তমানে তারা নিজেদের দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও নেতৃত্বের গুণ দিয়ে ব্যবসায়িক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করতে শুরু করেছেন। সমাজে নারীর অবস্থান বদলেছে, বদলেছে দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারায় আজ নারী উদ্যোক্তারা শুধু নিজস্ব সফলতার গল্পই লিখছেন না, বরং পরিবার, সমাজ ও দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছেন। যদিও তাদের পথচলায় সুযোগের পাশাপাশি প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে, তবুও এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা তাদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দিচ্ছে।
নারীদের উদ্যোক্তা হওয়ার যে প্রবণতা এখন দেখা যাচ্ছে, তা মূলত সময় ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের ফল। আগে নারীদের ব্যবসা বলতে সীমিত কয়েকটি খাত বোঝানো হতো; যেমন বুটিক শপ, সেলাই, হস্তশিল্প বা ঘরভিত্তিক খাদ্য উৎপাদন। কিন্তু ডিজিটাল যুগ নারীদের সামনে নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা বা ই-কমার্সের প্রসার তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে ঘরে বসেই ব্যবসা শুরু করার। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ওয়েবসাইট কিংবা মার্কেটপ্লেসÑএসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অনেক নারী খুব অল্প মূলধন নিয়ে শুরু করছেন এবং ধীরে ধীরে নিজেদের ব্র্যান্ড তৈরি করছেন। পাশাপাশি সরকারের নানামুখী সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ, ঋণ সুবিধা এবং বেসরকারি খাতের সহায়তা নারীদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথকে আরও সহজ করেছে।
নারী উদ্যোক্তাদের সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করলে সবচেয়ে আগে নজরে আসে তাদের বাজার বোঝার ক্ষমতা। তারা সামাজিকভাবে কোন পণ্য বা সেবার চাহিদা বেশি, মানুষ কোন ধরনের পণ্য পছন্দ করে এবং কীভাবে গ্রাহক ধরে রাখতে হয়Ñএসব বিষয়ে প্রায়ই স্বাভাবিক দক্ষতা দেখাতে পারেন। এই সুবিধার ফলে তাদের ব্যবসায় লাভজনকতা বেড়ে যায়। প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারীরা এখন বেশ অভিজ্ঞ; ডিজিটাল মার্কেটিং, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন পেমেন্ট, কনটেন্ট তৈরিÑএসব ক্ষেত্রেও তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এ ছাড়া একজন নারী উদ্যোক্তা যেমন নিজের আয় নিশ্চিত করেন, তেমনি অন্য নারীদের জন্য কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি করেন। এতে নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি সমগ্র পরিবার ও সমাজের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়।
তবে সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে নারীরা যে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন, তা এখনো কম নয়। উদ্যোক্তা হওয়ার প্রথম শর্তই হলো মূলধন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেক নারী নিজেদের নামে সম্পত্তির মালিক নন, ফলে ব্যাংকঋণের জন্য প্রয়োজনীয় জামানত দেখাতে পারেন না। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় নারী উদ্যোক্তাদের উদ্যোগকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না বা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। আর্থিক অসুবিধার কারণে অনেক নারী তাদের আইডিয়া বা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারেন না।
সামাজিক ও পারিবারিক মানসিকতা নারী উদ্যোক্তাদের আরেক বড় বাধা। আমাদের সমাজে এখনও ব্যবসাকে অনেক পরিবার পুরুষের কাজ মনে করে। ফলে নারীকে বাইরে বের হয়ে কাজ করা, সরবরাহকারীর সঙ্গে দেখা করা বা মিটিং করাÑএসব কাজকে বাধা দিয়ে দেখা হয়। নারীকে বলা হয় সংসার, সন্তান ও পরিবার দেখাই তাদের প্রধান কাজ। ফলে অনেক নারী নিজেদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মানসিক চাপে পড়েন। নিরাপত্তাহীনতা, রাস্তাঘাটে হয়রানি বা ব্যবসায়িক ভ্রমণে ঝুঁকি এসবও তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার উৎসাহ কমিয়ে দেয়।
আরেকটি বড় বাধা হলো দক্ষতার অভাব। ব্যবসা পরিচালনা করতে হলে পরিকল্পনা, হিসাবরক্ষণ, লিডারশিপ, ব্র্যান্ডিং, পণ্য ব্যবস্থাপনা, আইনি প্রক্রিয়া অনেক কিছু জানতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ নারী এসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পান না। ফলে ব্যবসার শুরুর পর ধারাবাহিকভাবে টিকে থাকা বা দ্রুত উন্নতি করা কঠিন হয়ে যায়। এছাড়া বাজারে প্রতিযোগিতা প্রবল হওয়ায় সঠিক নেটওয়ার্ক বা সংযোগ না থাকলে নারী উদ্যোক্তারা পিছিয়ে পড়েন।
যদিও চ্যালেঞ্জগুলো কঠিন, তথাপি নারী উদ্যোক্তা সেক্টরে নতুন দিগন্ত উšে§াচিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম-ভিত্তিক অনলাইন ব্যবসা বর্তমানে নারীদের জন্য অন্যতম বড় প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। ঘরে বসে শিশু বা পরিবার সামলে ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ নারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। দেশে স্টার্টআপ কালচার বৃদ্ধির ফলে অনেক নারী প্রযুক্তি খাতে নতুন উদ্যোগ নিয়ে আসছেন। ফিনটেক, এডটেক, হেলথটেক বা অনলাইন শিক্ষাÑএমন খাতগুলোয় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। তারা শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সাফল্য অর্জন করছেন।
অন্যদিকে নারী নেতৃত্ব উন্নয়ন কর্মসূচি, নারী উদ্যোক্তা নেটওয়ার্ক, বিভিন্ন উইমেন চেম্বারের সহায়তা নারীদের মেন্টরশিপ, প্রশিক্ষণ, বাজার সংযোগ ও লোন সুবিধা পেতে সহায়তা করছে। সরকারও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ, প্রদর্শনী, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও প্রশিক্ষণ কর্মশালা চালু করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা স্থাপন ও প্রসারে অর্থনৈতিক সহায়তা দিচ্ছে। এসব উদ্যোগ উদ্যমী নারীদের জন্য আশার আলো জ্বালিয়েছে। আরও একটি বড় পরিবর্তন হচ্ছে পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে। বর্তমানে অনেক পরিবার মেয়েদের ব্যবসা করতে উৎসাহ দিচ্ছে, প্রয়োজনীয় সমর্থন দিচ্ছে। তারা বুঝতে শুরু করেছে যে নারীর আর্থিক স্বাধীনতা শুধু পরিবারের উপকারই করে না, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মোবাইল ব্যাংকিং, ডিজিটাল পেমেন্ট এবং কুরিয়ার সেবার উন্নতি নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা সহজতর করেছে। তাদের পণ্য এখন দেশের যেকোনো প্রান্তে বা বিদেশেও পৌঁছানো সম্ভব।
নারী উদ্যোক্তাদের আরও এগিয়ে নিতে কিছু পদক্ষেপ জরুরি হয়ে উঠেছে। প্রথমত, সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নারীদের উদ্যোগকে ঝুঁকিপূর্ণ ধরে না নিয়ে বরং বিশেষ সহায়তার আওতায় আনা উচিত। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক প্রশিক্ষণের সুযোগ আরও বাড়াতে হবে। নারী উদ্যোক্তারা যে ক্ষেত্রেই কাজ করুন না কেন, ডিজিটাল দক্ষতা আজ অপরিহার্য। তৃতীয়ত, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে আইন প্রয়োগ ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার, যাতে নারীরা হয়রানির ভয়ে কাজ থেকে সরে না যান। চতুর্থত, বাজারে প্রবেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ আরও সক্রিয় হতে পারে, যাতে তারা দেশীয় বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় পণ্যের প্রদর্শন করতে পারেন। পরিবারেও নারীদের প্রতি সহযোগিতা ও সম্মান বৃদ্ধি করতে হবে।
নারী উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। তাদের সৃজনশীলতা, অধ্যবসায়, ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা এবং নেতৃত্বের গুণ কেবল তাদের ব্যক্তিগত উন্নয়নই নয়, জাতীয় অর্থনীতির অগ্রগতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যদিও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তবে সম্ভাবনার দিগন্ত আরও বিস্তৃত। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, নীতি সহায়তা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তারা ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিতে আরও বড় অবদান রাখবেন। তাদের অগ্রযাত্রা যতই জোরদার হবে, বাংলাদেশ ততই হবে আরও শক্তিশালী, উন্নত, সমতাভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি দেশ।
শিক্ষার্থী
গণিত বিভাগ,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্রিন্ট করুন





Discussion about this post