Print Date & Time : 22 September 2025 Monday 4:08 am

নারী নির্যাতন ও আইনের প্রয়োগ: কোথায় ঘাটতি

সাদিয়া সুলতানা রিমি : বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে নারী নির্যাতন একটি দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক সমস্যা। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, পারিবারিক সহিংসতা, বাল্যবিয়ে, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য—এসবের মধ্য দিয়ে নারীরা প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হচ্ছেন। নারী নির্যাতন রোধে আইন রয়েছে, আছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা প্রতিশ্রুতি। তবু বাস্তবে নির্যাতনের ঘটনা কমছে না, বরং অনেক ক্ষেত্রেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে নারী নির্যাতন ও আইনের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে সমাজের নানা শ্রেণি।

বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজারো নারী শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হন। আইন ও শাস্তির ভয় থাকা সত্ত্বেও নির্যাতনের মাত্রা কমছে না। গ্রামীণ এলাকায় বাল্যবিয়ে, যৌতুকের দাবি, পারিবারিক সহিংসতা এখনও স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে দেখা হয়। শহুরে সমাজে যৌন হয়রানি, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, সাইবার বুলিং ইত্যাদি ক্রমবর্ধমান। সামাজিক ও পারিবারিক চাপ, লজ্জা আর আইনি জটিলতার কারণে অধিকাংশ নারীই অভিযোগ আনতে সাহস পান না।

বাংলাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বেশ কিছু আইন রয়েছে। যেমন—

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩): ধর্ষণ, যৌতুকের কারণে মৃত্যু, অপহরণসহ নানা অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করেছে।

পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০: পারিবারিক পরিসরে সহিংসতার শিকার নারীদের সুরক্ষা ও প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ দিয়েছে।

নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩: হেফাজতে নির্যাতন বা মৃত্যু রোধে ব্যবস্থা নিয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮: সাইবার অপরাধ, অনলাইন হয়রানি ও ব্ল্যাকমেইলের শিকার নারীদের অভিযোগ জানানোর সুযোগ দিয়েছে।

এ ছাড়া সংবিধান নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে (অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮)। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ সিডওসহ নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ-সংক্রান্ত নানা কনভেনশনে সই করেছে।

আইন যতই আধুনিক হোক, প্রয়োগে ব্যর্থ হলে তা কার্যকারিতা হারায়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের আইনের বড় ঘাটতিগুলো হলো—অভিযোগ গ্রহণে অনীহা: অনেক থানায় নারী নির্যাতনের মামলা নিতে গড়িমসি করা হয়। ভুক্তভোগীকে অপমান বা ভয়ভীতি দেখানো হয়।

তদন্তের দীর্ঘসূত্রিতা: প্রমাণ সংগ্রহ, সাক্ষী হাজির, চার্জশিট তৈরি সবকিছুতেই বিলম্ব ঘটে। ফলে মামলার নিষ্পত্তি হতে বছর লেগে যায়।

ন্যায়বিচারে বিলম্ব: নারী নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থাকলেও মামলার সংখ্যা এত বেশি যে দ্রুত বিচার হয় না।

সামাজিক চাপ ও নিরাপত্তাহীনতা: ভুক্তভোগী নারী ও তার পরিবার মামলা করলে প্রতিপক্ষের হুমকি ও সামাজিক বয়কটের শিকার হন। এতে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন অনেকে।

সাক্ষী ও প্রমাণের সুরক্ষা নেই: ধর্ষণ বা সহিংসতার প্রমাণ যথাযথভাবে সংরক্ষণ হয় না, মেডিকেল পরীক্ষায় অবহেলা থাকে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মনোভাব: অনেক সময় নারী নির্যাতনকে ‘পারিবারিক বিষয়’ বা ‘মামুলি ঘটনা’ হিসেবে দেখা হয়।

 

আইনের প্রয়োগের ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে গভীর সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা।

পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা: নারীর প্রতি অসম্মান ও অধীনস্থ ভাবনা এখনও সমাজে প্রবল।

দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব: অভিযুক্ত প্রভাবশালী হলে মামলা নষ্ট হয়ে যায় বা ভুক্তভোগীকে আপস করতে বাধ্য করা হয়।

নারীর অর্থনৈতিক দুর্বলতা: আর্থিক স্বাবলম্বিতা না থাকায় নারী অনেক সময় বিচারব্যবস্থা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না।

আইনগত সচেতনতার অভাব: অনেক নারী জানেনই না, কোন ঘটনায় কীভাবে অভিযোগ জানাতে হবে।

 

 

আইন শুধু প্রণয়ন নয়, প্রয়োগের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।

অভিযোগ গ্রহণ সহজ করা: থানায় নারী নির্যাতনের অভিযোগ নেয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। নারী পুলিশ নিয়োগ ও বিশেষ ডেস্ক চালু করলে ভুক্তভোগী নিরাপদ বোধ করবেন।

দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানো, বিচারকদের প্রশিক্ষণ দেয়া এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলার রায় দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

সাক্ষী ও প্রমাণের সুরক্ষা: ভুক্তভোগীর মেডিকেল পরীক্ষা দ্রুত সম্পন্ন ও প্রমাণ সংরক্ষণের জন্য আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি: নারী নির্যাতনের মামলা পরিচালনায় পুলিশকে জেন্ডার সেনসিটিভ প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরি।

সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা: বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও গণমাধ্যমে নারী-পুরুষ সমতার শিক্ষা, নারীর প্রতি সম্মানবোধ এবং সহিংসতা প্রতিরোধমূলক ক্যাম্পেইন চালু করতে হবে।

নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন: কর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা সহায়তা, আইনি সহায়তার জন্য তহবিল গঠনএ—সব উদ্যোগ নারীদের শক্তি জোগাবে।

আইন সংস্কার: কিছু আইনের অস্পষ্ট ধারা বা শাস্তি কম হওয়ায় অভিযুক্তরা ফাঁকফোকর খুঁজে পায়। এসব আইন হালনাগাদ করা প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিশেষ উদ্যোগ ফল দিয়েছে। যেমন—ভারতে ‘ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট’ চালু করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ধর্ষণ মামলার রায় দেয়া হয়।

স্পেনে পারিবারিক সহিংসতার মামলায় ভুক্তভোগীদের জন্য হেল্পলাইন, আইনগত সহায়তা, আশ্রয়কেন্দ্র ইত্যাদি চালু রয়েছে। বাংলাদেশেও এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সাফল্য পাওয়া সম্ভব।

নারী নির্যাতন শুধু নারীর সমস্যা নয়; এটি পুরো সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক হুমকি। নারী যখন নিরাপদ থাকবেন, তখনই তিনি শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও উন্নয়নে অংশ নিতে পারবেন। আইনের কার্যকারিতা তখনই প্রমাণিত হবে যখন একজন নির্যাতিতা নারী দ্বিধাহীনভাবে থানায় গিয়ে মামলা করতে পারবেন এবং দ্রুত ন্যায়বিচার পাবেন। তাই শুধু নতুন আইন নয়, বিদ্যমান আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ, বিচারব্যবস্থার সংস্কার ও সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন—সবকিছুর সমন্বয়েই নারী নির্যাতন কমানো সম্ভব।

 

 

 

শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়