রোদেলা রহমান : প্রতি বছর উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের লক্ষাধিক শিক্ষার্থী বিদেশ পাড়ি জমান। এরে মধ্যে অধিকাংশই বিভিন্ন এডুকেশনাল কনসালট্যান্সি ফার্মের মাধ্যমে দেশের বাইরের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া ও ভিসা প্রসেসিং সম্পন্ন করে থাকে। ফার্মগুলো ক্ষেত্রভেদে একেকজনের কাছ থেকে৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। নিশ্চিত লাভজনক হওয়ায় এ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দ্রুত গজিয়ে উঠছে। ঢাকার পান্থপথের একটি সড়কেই এ ধরনের ২ হাজারের মতো ছোট-বড় কনসালট্যান্সি ফার্ম গড়ে উঠেছে বলে জানা যায়। এসব ব্যবসার আঁড়ালে কেউ কেউ প্রতারণার ফাঁ পেতে গ্রাহকের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি বিএসবি গ্লোবালের খায়রুল বাশার গ্রেপ্তারের পর থেকে এডুকেশন কনসালট্যান্সি ফার্মের প্রতারণার বিষয়গুলো সামনে আসে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চটকদার প্রচারণার মাধ্যমে অসাধু এজেন্সিগুলো প্রধানত দুই ধরনের প্রতারণা করে থাকে। এক, শির্ক্ষাীরে টাকা আত্মসাৎ করে বিশ্বব্যিালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া অসম্পন্ন রাখা ও বিদেশে না পাঠানো। দুই, ভিসা করে বাইরে পাঠিয়ে প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধা না য়ো। উচ্চশিক্ষা গ্রহণে দেশের বাইরে গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতারক চক্রগুলো এখন লাগামহীন। এটিকে মানব পাচার ও মানি লন্ডারিংয়ের নতুন ক্ষেত্র বলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এদিকে এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে দেশে শক্ত কোনো আইন নেই। কনসালট্যান্সি ফার্মগুলোর কর্মকাণ্ড তদারকিরও নেয় কোনো নির্ধারিত সংস্থা। কেবল পরামর্শক হিসেবে একটি ট্রেড লাইসেন্স বা কোম্পানি করেই প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। ফলে বিপুল অঙ্কের টাকা লোপাট করেও পার পেয়ে যাচ্ছে প্রতারকরা। বিপরীতে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থী ও তার পরিবার।
এ প্রসঙ্গে সেন্ট্রাল উইমেন্স’স বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হাসান সিরাজী শেয়ার বিজকে বলেন, যুগের চাহিদা, দেশে চাকরির বাজার সংকুচিত হওয়া এবং উচ্চশিক্ষার পিপাসা থেকে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এসব ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা বা পড়াশোনা নামে মাত্র। পড়ার ছুতো দিয়ে বিদেশে গিয়ে সেখানকার নাগরিকত্ব নেয়া অনেকের লক্ষ্য থাকে।
তিনি আরও বলেন, বেশির ভাগ এজেন্সি এই প্রচারণাতেই জোর য়ে। আর এতে প্রলুব্ধ হয়ে বিদেশ পড়ে আগ্রহীরা এজেন্সিগুলোর কাছে ধরনা দেয়। কিন্তু এসব শিক্ষার্থীর সুরক্ষা দেয়া সরকারের দায়িত্ব। এজেন্সিগুলো যাতে প্রতারণা করতে না পারে সেজন্য এদের কোনো না কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা জরুরি। আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করে প্রতারণার ঘটনাগুলো তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি এ ধরনের প্রতারণা সম্পর্কে বিদেশ গমনেচ্ছুক শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
ইউনেস্কোর গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল এডুকেশন শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার শিক্ষক-শির্ক্ষাী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ পাড়ি জমান।
এক্ষেত্রে ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের বিশ্বব্যিালয় থাকে পছন্দের শীর্ষে। মানসম্পন্ন ও ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা বিশ্বব্যিালয়গুলোতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই ভর্তি ও ভিসা সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম নিজেরাই সম্পন্ন করেন। তবে যারা একটু দুর্বল তাদের অনেকেই কনসালট্যান্সি ফার্মগুলোর চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়।
পান্থপথের মতোই ফার্মগেট, পল্টন, মতিঝিল, ফকিরাপুল, কাকরাইল, উত্তরা, গুলশান, বনানী, মহাখালীসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের কনসালট্যান্সি প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫১২টি। কিন্তু নামে-বেনামে সারা দেশে এই সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলেই আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেরই নেই ব্যবসা পরিচালনার প্রয়োজনীয় নথিপত্র। ফলে প্রতারণার শিকার হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না।
সরেজমিন এ ধরনের অন্তত ডজন খানেক প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখে শেয়ার বিজের এই প্রতিবেদক। প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরে সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদেশে শিক্ষার্থী পাঠানোর ক্ষেত্রে তারা চারটি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে থাকেন। সেগুলো হলো- শির্ক্ষাীর অর্থনৈতিক অবস্থা, একাডেমিক পরীক্ষার ফলাফল ও অভিজ্ঞতা, ভাষাগত দক্ষতা এবং বিদেশ গমনে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য। এই বিষয়গুলো বুঝে শিক্ষার্থীকে টার্গেট করা হয়।
যাদের যোগ্যতায় ঘাটতি থাকে তারে নানাভাবে প্রলুব্ধ করা হয়। এর মধ্যে আছে- বিশ্বব্যিালয়ের বৃত্তিলাভ, ভালো ফল ও ভাষাগত ক্ষতার (আইইএলটিএস, টোফেল বা এ ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতির স্কোর) পরীক্ষায় প্রক্সি দিয়ে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া কখনও কখনও জাল সার্টিফিকেট তৈরির সঙ্গেও জড়িত হয় এসব কনসালট্যান্সি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা।
এ ক্ষেত্রে প্রতারক ফার্মগুলো ‘সব করে বে, টাকা দিলে সব সম্ভব’ বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পর ওয়ার্ক পারমিট লাভের আশ্বাসও নে তারা। অফার লেটার দিয়ে ভর্তি ও ভিসার নিশ্চয়তাও দেয়া হয়।
এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। তবে প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করে অনেক শিক্ষার্থীই প্রতারনার শিকার হন বলেন অভিযোগ করেন।
বিদেশ ভর্তির নামে স্টুডেন্ট কনসালট্যান্সি করা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ফরেন অ্যাডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ফ্যাডক্যাব) সদস্য সংখ্যা ৫১২। ফ্যাডক্যাবের সেক্রেটারি হাবিবুল্লাহ খান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘যদি কোনো শিক্ষার্থী আমাদের মেম্বারশিপধারী এজেন্সি থেকে প্রতারিত হয় তাহলে প্রমাণসহ দরখাস্ত করতে পারেন। যথাযত প্রমাণ মেলে আমরা সেই এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
সার্ভিস চার্জ সম্পর্কিত তথ্য জানতে চাইলে হাবিবুল্লাহ খান আরও বলেন, ‘যদি কোন এজেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সরাসরি চুক্তিবদ্ধ না থাকে তাহলে তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমিশন পায় না। এ কারণে শিক্ষার্থীরে থেকে সার্ভিস চার্জ নেয়। যেমন- ইউরোপের প্রায় সব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এজেন্সির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ না থাকায় তারা শির্ক্ষাীদের কাছে থেকে ইচ্ছামতো সার্ভিস চার্জ নিতে পারে।’
প্রায় ২০ বছর ধরে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থী ভর্তির কাজ করছেন বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া স্টাডি সেন্টারের কর্ণধার আবদুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, কিছু প্রতিষ্ঠান এগুলো করছে। তাই গণহারে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনা ঠিক হবে না।
তিনি আরও বলেন, ’মালয়েশিয়ার বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিতে আমরা কোনো প্রসেসিং ফি নিই না। আর ভর্তির পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওনা অর্থ শিক্ষার্থী সরাসরি জমা দেয়। আমরা এই প্রসেসিং করি এ কারণে যে, শিক্ষার্থীরে ভর্তি করাতে পারলে সংশ্লিষ্ট বিশ্বব্যিালয় আমারে নির্ষ্টি পরিমাণ কমিশন বা টাকা দিয়ে থাকে। তাই যেসব প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নামে শির্ক্ষাীদের থেকে বড় অঙ্কের টাকা নেয় তারা প্রতারণায় যুক্ত।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী ড্রিমল্যান্ড স্টুডেন্ট কনসালট্যান্সি সম্পর্কে বলেছেন, তারা আমার চায়না যাওয়া নিয়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে টাকা নিয়েছে। এরপরে আমি তাদের কাছে প্রসেসিং সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা দুর্ব্যবহার করে। টাকা চাইলে নম্বর ব্লক করে দেয়।
মিরপুরবাসী নাহিদা ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, পান্থপরে একটি কনসালট্যান্সি ফার্মে কাজ করতেন সাব্বির নামের এক প্রতারক। সে আমার কাছ থেকে কানাডা যাওয়ার জন্য প্রায় ২ লাখ টাকা নিয়েছে। সাব্বির এবং তার বউ মিলে ওই এজেন্সিতে প্রতারণা কার্যক্রম চালাতেন। প্রসেসিং সম্পর্কে জানতে চাইলে টাকা লাগবে বলে বারবার কল করতেন। প্রায় তিন মাস পরে তারা তাদের অফিস থেকে পালিয়ে যায়। বহু শির্ক্ষাীরে সঙ্গে এই অনৈতিক কার্যক্রমগুলো তারা করেছেন। একজন শিক্ষার্থীর কাছে থেকে প্রায় ১১ লাখ টাকা নিয়ে ভুয়া অফার লেটার দিয়েছিল ওই লোকটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি গ্রীন রোডের এস বোর্ড ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস নামে একটি এজেন্সি থেকে কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি। কিন্তু তিন/চার মাস হয়ে গেলেও ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো সাড়া পাইনি। এস বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা আজ হবে-কাল হবে বলে ঘোরাতে থাকেকে। এই নিয়ে ওখান থেকে আমি কানাডার ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখন পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। এইভাবে আমার প্রায় তিন লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।