সানিয়া তাসনিম লামিয়া : নাগরিক অধিকার বনাম রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ—এই দ্বন্দ্ব আসলে সব কথা শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত টিকে থাকা এক অনন্ত বিতর্ক। রাষ্ট্র গঠনের মূল দর্শনই হলো নাগরিকের জীবন, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যখন রাস্তা নাগরিকদের নিরাপত্তা নামে কঠোর নিয়ন্ত্রণ অরূপ করে তখন সে নিয়ন্ত্রণকে স্বাধীনতার পরিপন্থি হয়ে ওঠে না? আবার যখন নাগরিকরা সীমাহীন স্বাধীনতার দাবি তুলে তখন কি সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে পড়ে না?
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই প্রশ্নটি আরও তীব্রভাবে উঠে আসে। একদিকে ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের অধিকার—এসব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না হলে গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সাইবার অপরাধ, জঙ্গিবাদ, ভুয়া তথ্য কিংবা দুর্নীতির লাগাম প্রান্তে রাষ্ট্রকে কিছু সীমাবদ্ধতা অরূপ করতেই হয়। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা কতটুকু হবে—এটাই আসল প্রশ্ন।
বিশ্বের সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে এ বিতর্ককে আরও উস্কে দিয়েছে। প্রযুক্তির অবাধ বিস্তার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দাপট, কৃত্রিম বুদ্ধিমতার নতুন চ্যালেঞ্জ সবই নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সীমারেখাকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলে প্রেক্ষাপট দাঁড়াচ্ছে এভাবে—স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য কোথায়? নাগরিকের কণ্ঠরোধ না করে আবার রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট না করে—কোন বিন্দুতে টানা হবে এই সূক্ষ্ম সীমারেখা?
নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সীমারেখা নিয়ে মানুষের মধ্যে মতভেদ প্রবল। বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপের ফলাফল দেখা যায় যে একদিকে স্বাধীনতা চায় অন্যদিকে নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু নিয়ন্ত্রণ ও মেনে নিতে প্রস্তুত।
বাংলাদেশ পরিচালিত একাধিক জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর ও ঋণাত্মক বক্তব্য নিয়ন্ত্রণের সরকারের পদক্ষেপ প্রয়োজন; তবে একই সঙ্গে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন যে এই নিয়ন্ত্রণ যদি স্বচ্ছ ও ন্যায্যভাবে প্রয়োগ না হয় তবে তা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করবে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জরিপে ও একই চিত্র ফুটে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের Pew Research Center-এর এক জরিপে দেখা যায়, ৫৫ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত স্বাধীনতার চেয়ে রাশি ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেন। তবে তরুণ প্রজন্মের বড় অংশই এর বিপরীতে মতপ্রকাশ করছে, তাদের মতে, স্বাধীনতা খর্ব হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মানুষ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে না তবে তারা চান নিয়ন্ত্রণ যেন হয় স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং নাগরিক অধিকার রক্ষাকারী কাঠামোর মধ্যে। সাধারণ মনে করে, ভুয়া তথ্য, সন্ত্রাসবাদ কিংবা অপরাধ মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োজন কিন্তু সেই শক্তি যদি অযৌক্তিকভাবে প্রয়োগ হয় তবে তা নাগরিক অধিকারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
ফলে জরিপের সারমর্ম দাঁড়ায়, নাগরিকরা একদিকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চান, আবার একই সঙ্গে তারা জন রাষ্ট্র যেন তাদের কণ্ঠরোধ না করে। এই দ্বৈত চাহিদায় রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্ব সৃষ্টির মূল কারণ হলো স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য খুঁজে না পাওয়া। ইতিহাস বলে রাষ্ট্র যখন নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তখন প্রায়ই নাগরিক স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার সীমাহীন স্বাধীনতা দিলে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা, আইন অমান্য ও সামাজিক অস্থিরতা।
প্রথমত, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামো এই দ্বন্দ্বকে প্রভাবিত করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো সাধারণত নাগরিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও অনেক সময় রাজনৈতিক স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ মূলক আইন প্রণয়ন করে। অন্যদিকে কৃতিত্ব বাদী ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ হয়ে ওঠে প্রধান হাতিয়ার।
দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তির প্রসারু একটি বড় কারণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর, ঘৃণমূলক বক্তব্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়া রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি নিতে নিতে বাধ্য করছে। কিন্তু একই নীতি যদি সীমার বাইরে চলে যায়, তবে নাগরিক স্বাধীনতার সংকুচিত হয়।
তৃতীয়ত, নিরাপত্তাজনিত হুমকি যেমন সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ মাদক বা দুর্নীতি, রাষ্ট্রকে কঠুর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে। এসব অপরাধ দমন করতে গিয়ে অনেক সময় সরকার অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে যার ফলে নাগরিক অধিকার হস্তক্ষেপ হয়।
চতুর্থত, জবাবদিহির অভাবে একটি বড় কারণ। নিয়ন্ত্রণ যখন শত্রুতা ও দায়বদ্ধতার বাইরে চলে যায় তখন তার স্বাধীনতার রক্ষার বোতলে দমননীতিতে পরিণত হয়।
সব মিলিয়ে কারণ দাঁড়ায়, রাষ্ট্র নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নিয়ন্ত্রণ চায় আর নাগরিকদের স্বাধীনতা ও মর্যাদা। এই দুই চাহিদার টানাপোড়েনই দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়।
নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্ব নিরসনে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো ভারসাম্য রক্ষা করা। রাষ্ট্র যেমন নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করেন, তেমনি নাগরিকের মৌলিক স্বাধীনতাকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপ কার্যকর হতে পারে।
প্রথমত, সংবিধানও আইনের শাসনকে সর্বোচ্চ মানদণ্ড হিসেবে স্থাপন করা জরুরি। প্রতিটি নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ হতে হবে সংবিধানসম্মত, ন্যায্য ও স্বচ্ছ। আইন যেন ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে নয় বরং নাগরিকের স্বার্থে প্রণীত হয়।
দ্বিতীয়ত, সততা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। যদি কোনো নিয়ন্ত্রণ অরুপ করা হয় যেমন মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, তাহলে তার স্পষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার এবং প্রয়োগের সময় যেন নাগরিকরা আইনি প্রতিকার চাইতে পারে। এতে নিয়ন্ত্রণ একতরফা দমননীতিতে পরিণত হবে না।
তৃতীয়ত, নাগরিক সচেতনতা বাড়ানো অপরিহার্য। অনেক সময় অধিকার ভোগ করতে গিয়ে মানুষ দায়ি়ত্ব ভুলে যায়। ভুয়া তথ্য না ছড়ানো, আয়না ভাঙা কিংবা সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখা, এসব নাগরিক দায়ি়ত্ব পালন করলে রাষ্ট্র কি অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণে যেতে হবে না।
চথুর্থত, প্রযুক্তিভিত্তিক সমাধান কেন যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ভুয়া খবর দাও মনি কেবল সেন্সরশিপ নয় বরং ফ্যাক্ট চেকিং প্ল্যাটফর্ম ও ডিজিটাল লিটারেসি বাড়ানো দরকার। এতে নাগরিকরা নিজেরাই ভ্রান্ত তথ্য চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে।
সংলাপ ভিত্তিক রাষ্ট্রনীতি গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে নীতি গ্রহণ করে তবে নিয়ন্ত্রণ হবে অংশগ্রহণমূলক স্বেচ্ছাচারী নয়।
অতএব সমাধান হলো ভারসাম্যপূর্ণ নীতি যেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় কিন্তু স্বাধীনতা খর্ব হয় না। এই সমন্বয়েই রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ককে ট্যাক্সই করে তুলতে পারে।
নাগরিক অধিকার আর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ—এই দ্বন্দ্বকে আসলে দ্বন্দ্ব হিসেবে নয়, ভারসাম্যের প্রশ্ন হিসেবে দেখা উচিত। রাষ্ট্র যদি অগণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেয় তবে নাগরিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন্ন হয়, আবার নাগরিক স্বাধীনতার নামে যদি সীমাহীন অরাজকতা তৈরি হয় তবে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়ে। তাই সীমারেখা হবে এমন যেখানে নাগরিকের মতপ্রকাশ, চিন্তা, ধর্মচর্চা ও জীবনধারণের স্বাধীনতা নিশ্চিত থাকে আর রাষ্ট্র কেবল তখনই নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করবে যখন জননিরাপত্তা, ন্যায়বিচার বা সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে। একটি পরিণত রাষ্ট্র নাগরিকের অধিকারকে রক্ষা করে এবং একই সঙ্গে সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখে। সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন গণতন্ত্রের মূল্যবোধ, দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান এবং সক্রিয় নাগরিক সমাজ। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয়ের জন্যই কল্যাণকর হবে—অধিক নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং স্বাধীনতা ও দায়ি়ত্বশীলতার সমন্বিত পথ।
সানিয়া তাসনিম লামিয়া
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়