রোদেলা রহমান : বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়েই চলছে দেশের অন্যতম ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মস গ্রুপের মালিকানাধীন সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটি। গত রোববার পুরোনো ও অকেজো একটি শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) বিস্ফোরিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষে। পরে সেখানে আগুন ধরে যায়। অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে ছাত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে। তবে এ ঘটনায়ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) ড. পারভীন হাসানের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
কাজী ফার্মের কর্ণধার কাজী জাহেদুল হাসান ও তার স্ত্রী ড. পারভীন হাসান। দুজনেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিলেও নিজেদের মালিকানাধীন সেন্ট্রাল উইমেনস বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বাড়াতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি। তবে মুরগি ও ডিমের ব্যবসায় তারা খুবই সফল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এসি ও লিফট নিয়ে একাধিকবার ছাত্রীরা লিখিত অভিযোগ দিলেও এই সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। দুর্ঘটনার পর থেকে ছাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রশাসনের অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখলেও শিক্ষার্থীরা সবকিছু বন্ধ করার ডাক দিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি গ্রুপে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ডিপার্টমেন্ট অব সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শ্রেণি প্রতিনিধি লিখেছেন, আমরা সব শিক্ষার্থী মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হবে। যতদিন পর্যন্ত আমাদের নিরাপদ ক্যাম্পাসের নিশ্চয়তা না দেয়া হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইন্টারনাল সমস্যার সমাধান না করা হবে, ততদিন আমরা কোনো ধরনের ক্লাস, পরীক্ষা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করব না।
তিনি আরও বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, শিক্ষা গ্রহণের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ ও একটি সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিটি শিক্ষার্থীর মৌলিক অধিকার। তাই আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে আমরা সব ধরনের ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দিচ্ছি। আমাদের এই আন্দোলন সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এবং শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।
শ্রেণি প্রতিনিধি আরও বলেন, আমরা প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছিÑদ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরাপদ ক্যাম্পাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। অন্যথায় আমাদের এই আন্দোলন চলমান থাকবে।
শিক্ষার্থীরা এ ঘোষণা দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইলিয়াস আহমেদ এক নোটিশে বলেন, কারিগরি ত্রুটির কারণে গতকাল ক্লাস বন্ধ থাকলেও আজ মঙ্গলবার থেকে আবার তা চালু করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৫ বছরের পুরোনো কয়েক ডজন এসি এ অগ্নিকাণ্ডের কারণ। এখানকার প্রতিটি এসি একটি করে বোমা বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, এসিতে ক্লাসরুম ঠান্ডা না হলেও কেবল দেখার জন্য রাখা হয়েছে। কাজী গ্রুপের ব্যবহƒত এসব অচল এসি এখন শিক্ষার্থীদের জন্য বড় আতঙ্ক।
তবে এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। ছাত্রদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সব ‘নাটের গুরু’। তিনি খরচ কমানোর কথা বলে ভিসিকে খুশি রাখেন, আর প্রতিষ্ঠান চালান সরকারি প্রাইমারি স্কুলের মতো। এখানে অর্থসংশ্লিষ্ট কোনো কিছুই রেজিস্ট্রারের কারণে বাস্তবায়িত হয় না। উদাসীন, কৌশলী ও মতলববাজ রেজিস্ট্রারের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নেই। আর এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছু যা-তা অবস্থা। এখানে মেইনটেন্যান্স খাতে খরচ হয়, কিন্তু তা চোখে পড়ে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ড. আহমেদ আব্দুল্লাহ জামাল শেয়ার বিজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বিস্ফোরণ হয়নি। এ বিষয়ে আর কোনো কথা নয়।’ এই বলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনোভাবেই ক্যাম্পাসে অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাহীনতা মেনে নেয়া যায় না। শিক্ষার্থীরা যাতে ভয়মুক্ত পরিবেশে পড়াশোনা করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আগামীকাল থেকেই আবার ক্লাস শুরু হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে আগামী শনিবার একটি তদন্ত টিম বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে ক্যাম্পাসে আসছে।
গতকাল সোমবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক ছাত্রী তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একজন লেখেন, এসি ও লিফট অকেজো। দুটি লিফট আছে, দুটিরই মেয়াদ শেষ। যেকোনো সময় তার ছিঁড়ে পড়তে পারে। প্রতিদিন এটা একাধিকার ঝাঁকি মারে, আটকে যায়। আর এসি বিকট শব্দ করে। ১৫ বছরের পুরোনো সব এসি। একটি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। বাকিগুলো বিস্ফোরণ হবে একে একে। একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দেয়া হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ভিসি একজন নারী। কিন্তু তিনি আমাদের উন্নত শিক্ষা ও নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।’
অপর এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, এখানে কোনো কিছুই ঠিক নেই। জোড়াতালি দিয়ে চলছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে একবার কিছু নষ্ট হলে তা আর ঠিক হয় না। সরকারি অফিসের মতো অবস্থা অনেকটা। তবে নিজেদের ব্যাপারে ষোলআনা। টিউশন ফি দিতে দেরি হলে জরিমানা আদায় করা হয়। কোনো মাফ নেই। এখানে বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে তার টনক নড়বে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক শেয়ার বিজকে বলেন, কাজী ফার্মস গ্রুপ বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে ব্যবসা করলেও কোনো বিনিয়োগ করছে না। এখানে শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা একেবারে সামান্য। এ কারণে যারা পারছে অন্যখানে চলে যাচ্ছে, আর যারা পারছে না তারা কোনোমতে শিক্ষাদান করছে। তিনি বলেন, মালিকপক্ষের সামর্থ্য আছে, কিন্তু উদ্যোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপদ পরিবেশ ও উন্নত শিক্ষার জন্য তাদের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। কিন্তু ইয়েসম্যান রেজিস্টারের কারণে আমাদের আবেদন-নিবেদন কোনো কাজে আসে না। উদাসীন, কৌশলী ও সুবিধাবাদী রেজিস্ট্রারই এখানকার সব উন্নয়নের বাধা বলে মনে করেন তিনি।

Discussion about this post