জোবায়েদা জয়া : হিমালয়ের কন্যা নেপাল আজ পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই দেখা যায় দেশটির রাস্তাঘাটে আগুন, সংসদ ভবন দাউ দাউ করে জ্বলছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভাঙচুরে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে রাষ্ট্রযন্ত্র আর এসব কর্মকাণ্ডে সবাই বিজয় উল্লাসে মত্ত হয়ে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছেÑ সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ অরাজকতার প্রতিচ্ছবি। যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল দুর্নীতি, বৈষম্য এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে, তা আজ রূপ নিয়েছে এক বিশাল ধ্বংসযজ্ঞে, যা কেবল সম্পদই নয়, সমাজের আস্থা, শান্তি এবং মানুষের নিরাপত্তাকেও বিঘ্নিত করেছে। কেউ বলছে এটা ‘বিপ্লবের ঝড়’ কেউ বলছে নতুন দিগন্তের সূচনা। কিন্তু এই ঝড় কি সত্যিই নতুন ভোর আনার জন্য, নাকি কেবল রক্ত ও ছাইয়ের মাধ্যমে সমাজকে ধ্বংস করার খেলা?
গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে নেপালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে সাময়িকভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি হলে দেশটির তরুণ সমাজ তীব্র প্রতিবাদে ভেঙে পড়ে। এই নিষেধাজ্ঞা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার বিষয়ে তরুণ সমাজের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা ক্ষোভকে ট্রিগার করে। তাদের আন্দোলন শান্তভাবে শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে প্রশাসনের করা গুলি, রাবার বুলেট, ওয়াটার ক্যানন, টিয়ারশেলের মুখে আরও তিক্ত থেকে তিক্ততর হয়। কারফিউ জারি, নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ, রাষ্ট্রীয় চাপ ও ১৯ জন নিহতের ঘটনার পর তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে পরবর্তী সময়ে তারা ব্যারিকেড ভেঙে সংসদে প্রবেশ করে, অগ্নিসংযোগ করে, ভাঙচুর করে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করে আবার সেই ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটি আপলোড করে সো-কলড্ কুলনেস দাবি করে উল্লাস করে। এত শত চাপের মুখে নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রধানমন্ত্রী ওলি পদত্যাগ করেছেন। একজন অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর নাম আলোচনায় আসছে। কিন্তু এই ক্ষমতার আসনবদল কি রক্তের দায় মেটাতে পারবে? নাকি শুধু ইতিহাসে আরেকটি ‘বিপ্লব’ লেখা হবে, যার ভেতরে রয়ে যাবে হাজারও পরিবারে অশ্রুর দাগ?
আসলে বিপ্লব মানে কি অশ্রু আর রক্তের দাগ? লুটপাট, ধ্বংস আর দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি? নিজের মানবিকতা বিসর্জন আর আপন সংস্কৃতি নির্মূলের অসুস্থ প্রতিযোগিতা?
বিপ্লব তো মানেÑ পরিবর্তন, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, বৈষম্যের অবসান। কিন্তু নেপালে আজ যা ঘটছে, তাতে মনে হচ্ছে ক্ষোভের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সবকিছু, অথচ ন্যায় ও শান্তির আলো এখনও অস্পষ্ট।
এখনকার জেনারেশন জেনজি স্বাভাবিকতই খুবই আপগ্রেডেড, অধৈর্য। তারা না শুনতে অভ্যস্ত নয়, যেকোনো ফলাফল তাদের তৎক্ষণাৎ দরকার। তাদের চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা অনেকের থেকে অনেক এগিয়ে। তারা আগেরকালের মানুষের মতো আবেগ দিয়ে চিন্তা করে না, তারা মগজের কথা শোনে। তারা সেই প্রজš§, যারা ডিজিটাল যুগে বড় হয়েছে, তথ্যপ্রাপ্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা তাদের স্বাভাবিক অধিকার বলে মনে করে। তাদের আন্দোলন শুধু ‘বিক্ষোভ’ নয়; এটি একটি প্রতীকী আহ্বানÑ ‘আমাদের কণ্ঠ শোনা হোক, আমাদের আশা নষ্ট করা যাবে না।’ তাদের শক্তি দেখানো হয়েছে রাস্তায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, এবং কখনও কখনও ভাঙচুর ও ধ্বংসের মাধ্যমে।
তাদের এই বিপ্লব পরিণত হলো ধ্বংসের লীলা খেলায়। অপসংস্কৃতির কালগ্রাসে তারা হারিয়ে গেছে। তাদের উদ্দেশ্য সৎ থাকলেও কৌশলগত দিক থেকে তারা ভুল। দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করার মাঝে কোনো মাহাত্ম্য নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি দেশে তরুণরা ক্ষোভের বসে কিভাবে দেশের সংসদে আগুন লাগাতেও দ্বিধাবোধ করেনি। যেখানে সংরক্ষিত ছিল দেশের সংবিধান, অতিপ্রয়োজনীয় নথিপত্র ও দলিল। দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, সামরিক কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের বাড়ি, থানা, গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর, গাড়ি-ঘোড়া- ধ্বংসের খেলায় কোনোটিই বাদ যায়নি। এমনকি কারাগার পর্যন্ত তারা ভাঙচুর করেছে ফলে কারাগার থেকে ১৩ হাজার ৫০০ জন ভয়ংকর আসামি পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এ ঘটনাটি দেশে কত বড় অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে এ বিষয়ে তাদের কোনো ধারনাই নেই। অপরাধ যত বড়ই হোক না কেন, অপরাধীকে শাস্তি দিতে গেলে কিছুটা হলেও মানবিকতা বোধ রাখা উচিত। এতটাই অমানবিক হওয়া উচিত না যে নিজের মনুষ্যত্ববোধ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। নেপালে মন্ত্রী পদত্যাগ করার পরেও তাদের অর্ধনগ্ন কিংবা উলঙ্গ করে মারধর করার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, সেই ভিডিও তারা আনন্দের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করে, মন্ত্রীদের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বাসভবনে থাকা অবস্থায় আগুন লাগিয়ে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়। এসব ঘটনা তারা নির্দিধায় ধারণ করছে, সেই ধ্বংসযজ্ঞের সামনে টিকটক করে নিজেদের ‘কুল’ ‘ইনফিনিট অরা’ র মতো জেনজি টার্মগুলোর মাধ্যমে তাদের মহৎ কর্মের জন্য বাহবা প্রত্যাশা করছে। তারা ঘটনাগুলোকে বিপ্লব দাবি করছে। কিন্তু আসলে একজন বিবেক বোধসম্পন্ন মানুষের চোখে এটি বিপ্লব হতেই পারে না।
নেপালের ইতিহাস, শিল্প ও সাহিত্যÑ সবই ওই দেশের অহংকার। যেখানে চর্যাপদ পুঁথি সংরক্ষিত আছে নেপালের জাতীয় আর্কাইভ এ, সেখানে আজকের আগুন আমাদের মনে করিয়ে দেয়Ñ যতই ধ্বংস হোক, সংস্কৃতির মূল শেকড় রক্ষা করা জরুরি। একই সঙ্গে একটি দেশের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারও দেশের মহা মূল্যবান সম্পদ। এটি দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধারন করে, সংরক্ষণ করে, সবার কাছে জানান দেয় এর পূর্ব ইতিহাস সম্পর্কে। সেই কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারও তারা পুড়িয়ে দিয়েছে। লাইব্রেরি কে বলা হয় মনের হাসপাতাল। জ্ঞানের দুয়ার। অথচ আজকের তরুণ সমাজ নিজ হাতেই সেই জ্ঞানের দুয়ার বন্ধ করে দিল। সৌভাগ্যবশত, চর্যাপদ এখনও অক্ষত আছে। কিন্তু যদি এই আগুন ইতিহাসের মূলকেন্দ্রে পৌঁছায়, তাহলে ক্ষতি অনিবার্য হবে। ইতিহাস বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আগামীর জেনারেশন ইতিহাস ও সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত হবে।
বিপ্লব মানে মনুষ্যত্বের বিসর্জন নয়। বিপ্লব মানে পুরোনো, বিকল, দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে দুর্নীতিমুক্ত নতুন দিগন্তের সূচনা করা,শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, রাষ্ট্র ও মানুষের ধ্বংস করা নয়। তারা দেখাচ্ছে, এক প্রজš§ যা সংস্কারহীনতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে কিন্তু তাদের পদ্ধতি তথাকথিত এই বিপ্লবকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কেবল সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য ছাড়া এটি আর বেশি কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। তারা যে দীর্ঘকালীন অপশাসন, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বজ্রকণ্ঠ ধরার সাহস সঞ্চার করতে পেরেছে এর জন্য তাদের সাধুবাদ জানাই তবে সেই সঙ্গে এই সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ব্যাপারেও তীব্র নিন্দা জানাই।
সত্যিকারের বিপ্লব আসে গড়ে তোলার শক্তি, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের অধিকার রক্ষার মাধ্যমে। তরুণদের উচ্ছ্বাস, ক্ষোভ ও উদ্যোগ সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই শক্তিকে ধ্বংস নয়, গঠনের দিকে পরিচালিত করা না পারলে, বিপ্লবের নামে এই খেলা কেবল ছাই ও রক্তের ইতিহাস হিসেবে স্মৃতিতেই রয়ে যাবে, বাস্তবে আর দেখা যাবে না।
নেপালের রাস্তায় আজ যে ঝড় উঠেছে, তা তরুণ প্রজšে§র আশা ও ক্ষোভের প্রতীক। জেনজির আলোকে সমাজকে নতুন ভোরের দিকে ধাবিত করা সম্ভব। তবে সেই ভোর আসে কেবল তখন,
যখন ধ্বংস নয়, পরিবর্তন গঠনমূলক ও ন্যায়ের পথে করা হবে।
দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ যৌক্তিক। কিন্তু বিপ্লব যদি ধ্বংসের উল্লাসে পরিণত হয়, তবে তার পরিণতি হয় শুধু ছাই যেখানে দাঁড়িয়ে নতুন স্বপ্ন গড়া যায় না। বিপ্লবের নামে ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে; প্রকৃত বিপ্লব মানে গড়ে তোলা, স্থাপন করা এবং সমাজকে উন্নতির পথে এগিয়ে নেয়া। সবসময় আবেগ দিয়ে নয়, বিবেক দিয়েও চিন্তা করা উচিত।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Discussion about this post