মো. মোখলেুছুর রহমান, পটুয়াখালী : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অতিবর্ষণ আর তীব্র খরা-তাপদাহ এবং সাগর-নদী মোহনায় অসংখ্য ডুবোচর ও অস্বাভাবিক দূষণের কারণে উপকূলে পুরো ভরা মৌসুমেও চলছে ইলিশের চরম আকাল। এতে ইলিশ ধরার সঙ্গে জড়িত জেলে-আড়তদারসহ সাগরপাড়ের জেলা পটুয়াখালীর লাখো মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে হতাশা। ইলিশের রাজ্যখ্যাত সাগর পাড়ের জেলা পটুয়াখালীতে ইলিশের চরম আকাল, দাম আকাশচুম্বী। নাগালের বাইরে ইলিশের দাম থাকায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা এখন প্রায় রুপালি ইলিশের স্বাদ ভুলতে বসেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে দারুন প্রভাব পড়বে মৎস্য সম্পদ আহরণের ওপর। কর্মহীন হয়ে পড়বে এই পেশার সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ মানুষ।
মৎস্য খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, ইলিশ লোনা পানির মাছ হলেও ডিম ছাড়ার সময় চলে আসে মিঠা পানিতে। প্রজননকালীন সময়ে ইলিশের প্রয়োজন হয় অনুকূল পরিবেশ-প্রতিবেশের। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনে তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, সাগরে অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাস, তীব্র তাপপ্রবাহ, সাগর মোহনায় ডুবোচর, নদ-নদীতে পালি পড়ে নাব্য হ্রাস, শিল্পও মানুষ্য বর্জ্য নদ-নদীতে অপসারণ, দখল দূষণ এবং নদী-মোহনায় অসংখ্য বেহেনতি ও বাধাজাল দিয়ে ইলিশের মাইগ্রেশানে মারাত্মকভাবে বিঘ্নের সৃষ্টি করা হচ্ছে। সাগরের লোনা পানিতে বেড়ে ওঠা একটি মা ইলিশ ১৫ থেকে ২০ লাখ ডিম ধারণ করে প্রজননকালীন পটুয়াখালীর তেঁতুলিয়া, রাবণাবাদ, আগুনমুখা, বুড়াগৌরাঙ্গ, আন্ধারমানিক ও পায়রা-বিষখালীর অভয়াশ্রমে আসতে বাধার সম্মুখীন হয়। আবার ডিম ছাড়া শেষে সাগরে ছুটতেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়। নদ-নদীর মিঠা পানিতে মা ইলিশের পোনা বছরজুড়ে নিধন করা হয় বিভিন্নভাবে। এসব ইলিশের ঝাটকা পরিপূর্ণ ইলিশ হতে সাগরের লোনা পানিতে যেতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সাগর নদী মোহনায় জেগে উঠা ডুবোচর ও বাঁধাজাল ও কারেন্ট জাল। ছোট থাকতেই পেনা ইলিশ মারা পড়ে এসব জালের কারণে। শুধু ঝাটকা বা ছোট ইলিশই নয়. অন্যান্য প্রজাতিরও বিভিন্ন ধরনের মাছ মারা যায়।
পটুয়াখালীর জেলে ও ব্যবসায়ী এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় জানা গেছে, বৈশাখ থেকে আশ্বিন এই ছয় মাস ইলিশের পুরো ভরা মৌসুম। তাদের হিসাব মতে, মৌসুমের অর্ধেকের বেশি সময় প্রায় শেষ। ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা পর থেকে সব রসদ নিয়ে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে সাগর বুকে চিবিয়ে ফিরলেও উপকূলের নদী ও সমুদ্রে মিলছে না কাক্সিক্ষত ইলিশের দেখা। দিন-রাত কঠোর খাটুনি শেষে উত্তাল সাগরে পুড়ে ইলিশ না পেয়ে ভেসে থেকে দেনার বোঝা ভারী করে শূন্য হাতে ঘাটে ফিরছেন উপকূলের জেলেরা। আশায় বুক বেঁধে থাকা জেলেরা এখন হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। ইলিশ না পাওয়ায় তাদের দাদন আর ঋণের বোঝা দিন দিন ভারী হচ্ছে। কলাপাড়ার সমুদ্রগামী ফিশিং বোটের প্রধান মাঝি খলিল উদ্দিন সম্প্রতি জানান, ভারত ও মিয়ানমারের পতাকাবাহী শতাধিক অত্যাধুনিক জাহাজ সব সময় সাগরের বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থান করছে। প্রতিটি জাহাজের সঙ্গে রয়েছে ২০ থেকে ২৫টি মাছ ধরার ছোট ট্রলার। ওইসব ট্রলার থেকে যান্ত্রিক উপায়ে একধরনের জাল ফেলা হয় সাগরে। এগুলো লাশা জাল নামেও পরিচিত। তিন স্তরের ওই জাল ভেদ করে ছোট-বড় কোনো ইলিশই সাগরের বাংলাদেশ সীমান্তে আসতে পারছে না। ফলে দিন-রাত উত্তাল সাগরে জাল ফেলে মাছ না পেয়ে খালি হাতে তাদের ঘাটে ফিরতে হচ্ছে। লোকসানে পড়ছেন ট্রলার মালিকসহ উপকূলের জেলেরা। এই কারণে বর্ষার ভরা মৌসুমেও দক্ষিণাঞ্চলের জেলেদের জালে কাক্সিক্ষত ইলিশের দেখা মিলছে না। দিন দিন তারা ঋণগ্রস্ত হচ্ছে বলেও তিনি জানান। অল্প পরিমাণে মাছ বাজারে পাওয়া গেলেও তার দাম আকাশচুম্বী। বর্তমানে ইলিশ মণপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ ১২ হাজার টাকায়। ফলে কেজি প্রতি দাম দাঁড়াচ্ছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা। এর মধ্যেও যদি দুই কেজি বা তার চেয়ে বড় ইলিশ পাওয়া যায়, তাহলে প্রতি কেজিতে দাম আরও বেশি।
পটুয়াখালীর নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে ইলিশ কিনতে এসেছেন নাম প্রকাশ করে বলেন, পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানের জন্য এক কেজি ২২ গ্রামের দুটি ইলিশ নিলাম ৪ হাজার ৬০০ টাকায়। তিনি বলেন, এই বাজারে সাত থেকে আট বছর আগেও আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে প্রতিদিন মণে মণে ইলিশ উঠতো। অথচ এখন আমার ইলিশই নেই। তারপর নানা হাত পেড়িয়ে সিন্ডিকেটের কারণে এত বেশি দাম হয় যে আমাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মৎস্য বন্দর মহিপুর-আলীপুর। এই দুই বন্দরের জেলেরা জানান, ইলিশ না পেয়ে কষ্টে দিন কাটছে।
মহিপুর মৎস্যবন্দর আড়তদার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুমন দাস জানান, অস্বাভাবিক বৃষ্টি ও অতিখড়া এবং নদীতে ফেলানো মায়লা সাগরের তলদেশে জমে অক্সিজেনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। যার জন্য সাগরের উপরিভাগে মাছের বিচরণ কমে যাওয়ায় তীরে ইলিশ খুবই কম আসছে। এসব কারণেই ইলিশের এত সংকট।
সাগর পাড়ের উপজেলা কলাপাড়ার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহার ভাষ্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও আবহাওয়ার বিমাতাসূলভ আচরণ, জেলের ইলিশ শিকারের আধুনিক সরঞ্জামাদির অভাব, সাগরের ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার এলাকায় ডুবোচর, নাব্য সংকট ও পলিউশন সমস্যার কারণে ইলিশের মাইগ্রেশন হচ্ছে না। এসব কারণে ইলিশের মাইগ্রেশন রুটও পরিবর্তনের সম্ভাবনাসহ নানা কারণে আজ ইলিশের এই দুষ্প্রাপ্যতা। সাগরে ইলিশের সহজলভ্যতা নিশ্চিতে স্টক ও মাইগ্রেশন রুট নিয়ে গভীরভাবে গবেষণার দাবি এই কর্মকর্তার।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার জেলে সুজন আকন বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা নেই তবে সাগর উত্তাল। ঘন ঘন সিগন্যাল থাকায় সাগরে গিয়ে জেলেরা টিকতে পারে না। তাছাড়া সাগরেও চাহিদা মতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এখন এক একটি বোট নিয়ে সাগরে যেতে ন্যূনতম পাঁচ লাখ টাকার মালামাল প্রয়োজন হয়। সেই টাকা উঠবে কিনা, তারতো নিশ্চয়তা না থাকায় হতাশ ইলিশ আহরণের সঙ্গে জড়িতরা।
মহিপুর ও আলীপুর মৎস্য বন্দর ঘুরে দেখা গেছে, ৪০০ গ্রাম সাইজের প্রতিমণ ইলিশের দাম ৬৮ থেকে ৭০ হাজার, ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম সাইজের প্রতিমণ ইলিশ এক লাখ টাকা, এক কেজির বেশি সাইজের প্রতিমণ ইলিশ ১ লাখ ৮ থেকে ১ লাখ ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। বড় আকারের ইলিশের দাম গত ১০ দিনের ব্যবধানে মণপ্রতি ১২ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৎস্য অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মো. সাজেদুল হক জানান, ‘ইলিশ কম পাওয়ার কারণ হিসেবে জলবায়ুর প্রভাব জনিত প্রভাব তো আছেই, তারপর সাগরের অতিরিক্ত লবণাক্ততা, সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধি, অসংখ্য ডুবোচর, নদীর নাব্য হ্রাস, অবৈধ জালের ব্যবহারের ফলে সাগরের মাছ ইলিশের নদীতে এসে মাইগ্রেন দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর কারণেই আজ ইলিশের এই দুষ্প্রাপ্যতা। একে সহনীয় পর্যায়ে আনতে সরকারি নিয়ম-কানুন মেনে চলা ও জেলেদের সচেতনতা বৃদ্ধি করে সরকারি ডিকলারেশনগুলো মেনে চলতে মৎস্য বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।’
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, পটুয়াখালীতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫১৮৩৯.৫৬৪ মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭০০০২.০০ মেট্রিক টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৭৯৬৬.৫৫ মেট্রিক টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭২০৬৩.০০ মেট্রিক টন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৭৬৭১.০২ মেট্রিক টন ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫৪৭০৩.১০ মেট্রিক টন ইলিশ অহরিত করা সম্ভব হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম জানান, আবহাওয়া পরিবেশ প্রতিবেশ সবকিছু অনুকূলে থাকলে চলতি অর্থবছরেও ৭২ থেকে ৮০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।