মীর আনিস : ঢাকার আকাশে শীতল কুয়াশা নেমে এসেছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামছে মতিঝিলের ব্যাংকপাড়ায়। ফাঁকা রাস্তায় অল্প কিছু গাড়ির আলো নিভু নিভু করে জ্বলছে। কিন্তু একটি ব্যাংকের উঁচু ভবনের ভেতরে আলো এখনও জ্বলছে। এক কোণে বসে আছেন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, স্যুটপরা, ক্লান্ত চোখে কাগজপত্রে চোখ বোলাচ্ছেন। টেবিলে সাজানো লোন অ্যাপ্রুভালের ফাইল, শেয়ারহোল্ডারদের রিপোর্ট, ঝুঁকির বিশ্লেষণ-সবই তার চোখের সামনে। তবুও কোনো কাগজেই তিনি সই করছেন না। কারণ তিনি জানেন, ফাইলের ভেতরে যা লেখা আছে তা নীতিগতভাবে ভুল, প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির কারণ হবে। তবুও তার মাথায় ঘুরছে একটিই প্রশ্ন ‘চেয়ারম্যান কী চান?’ উত্তরটা খুব ভালো করেই তিনি জানেন, আর সেই উত্তরই তাকে স্তব্ধ করে রেখেছে।
বাংলাদেশের বেসরকারি ব্যাংক খাতের এটাই যেন প্রতিদিনের দৃশ্য। প্রায় ৫০টির মতো বেসরকারি ব্যাংকে সিইওরা পদবি অনুযায়ী সর্বোচ্চ হলেও কার্যত তারা বন্দি। তাদের সিদ্ধান্তের সীমারেখা আঁকেন চেয়ারম্যানরা। চেয়ারম্যানরা প্রভাবশালী, অনেক সময় রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদার, আবার কখনও শেয়ারের বড় অংশের মালিক। তারা ব্যাংককে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভেবে চালান। অথচ প্রকৃত মালিক সাধারণ বিনিয়োগকারীরা, যারা শেয়ারবাজার থেকে কিনে পুঁজির জোগান দেন। সেই বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষার বদলে সিইওদের মাথায় ঘুরে ফিরে আসে একটাই ভয়- চাকরি যাবে না তো?
এই ভয় যেন ব্যাংকিং খাতকে গ্রাস করেছে। গত ২০ বছরে শতাধিক সিইও এসেছেন-গেছেন, কিন্তু একজনও সাহস করে দাঁড়াননি। কেউ প্রতিবাদ করেননি, কেউ বোর্ডরুমে ‘না’ বলেননি। বরং তাদের অনেকেই চেয়ারম্যানদের ব্যক্তিগত খেদমতে লিপ্ত থেকেছেন। শোনা যায়, কোনো কোনো প্রভাবশালী চেয়ারম্যান জুমার নামাজে গেলে সিইওরা তার সঙ্গে দৌড়ে যেতেন, কেউ কেউ আবার নামাজ না পড়ে বাইরে দাঁড়িয়ে জুতা পাহারা দিতেন। কেউ বাজারের ব্যাগ বহন করেছেন, কেউ চেয়ারম্যান পরিবারের কাজ সারতে ছুটেছেন। কারণ, যেসব সিইওরা এসব করেন না, তারা চেয়ারম্যানের প্রিয়পাত্র হতে পারেন না। দেশে এ রকম ব্যক্তিত্বহীন সিইওদের সংখ্যা কম নয়। দৃশ্যগুলো শোনায় হাস্যকর, কিন্তু আসলে এটি একটি জাতীয় ট্র্যাজেডি। কারণ এখানে নেতৃত্ব ভেঙে গিয়ে কেবল ভীরুতা আর চাকরির ভয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সাধারণ ব্যাংকারদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, সিইওরা এতো নিচে কীভাবে নামতে পারেন? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো, এ দেশে মেধার চেয়ে তেলবাজদের কদর বেশি। তাই ইয়েসম্যান না হলে বড় পজিশন পাওয়া যায় না। আর এ কারণেও দক্ষ, যোগ্য ও ব্যক্তিত্ববান সিইওরা ব্যাংকিং খাতে আসতে চান না।
অথচ বিশ্বের অন্য প্রান্তে ছবি ভিন্ন। ভারতের হায়দ্রাবাদের এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেন সত্য নাদেলা। পড়াশোনা শেষে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান, আর একদিন দাঁড়িয়ে যান বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী প্রযুক্তি কোম্পানি মাইক্রোসফটের নেতৃত্বে। তখন কোম্পানিটি এক ধরনের স্থবিরতায় ভুগছিল। পুরোনো সফটওয়্যার ব্যবসা ঝিমিয়ে পড়ছিল, গুগল আর অ্যাপল প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময় বোর্ডরুমে নাদেলা সাহস করে বলেছিলেন- ‘আমাদের নতুন কিছু করতে হবে, ক্লাউড কম্পিউটিং ভবিষ্যৎ।’ বোর্ড তখন দ্বিধায় ভুগছিল, এত বড় ঝুঁকি নেবে কি না। কিন্তু নাদেলার দৃঢ় কণ্ঠে ঝরে পড়েছিল আত্মবিশ্বাস। তিনি বলেছিলেন ‘ব্যর্থ হলেও চেষ্টা করতে হবে। থেমে থাকা মানে মৃত্যু।’ সেই সাহসী সিদ্ধান্তই আজ মাইক্রোসফটকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
ঢাকার ব্যাংকের সেই নির্বাহীর সঙ্গে নাদেলার এই পার্থক্য আকাশ-পাতাল। একজন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয় পায়, আরেকজন ভবিষ্যৎ বদলাতে ভয়কে জয় করে।
দক্ষিণ ভারতের আরেকটি শহরে জন্মেছিলেন সুন্দর পিচাই। গুগলে তিনি যোগ দিয়েছিলেন একেবারে নিচের পদে। ধীরে ধীরে উঠে আসতে আসতে যখন তিনি সিইও হলেন, তখন গুগল নতুন দিক নিয়ে দ্বিধায় ছিল। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে বিনিয়োগ করবে কি না, তা নিয়ে বোর্ড দ্বিধাবিভক্ত। পিচাই দাঁড়িয়ে বলেছিলেন- ‘ভবিষ্যৎ এআই-এর ওপর দাঁড়াবে। যদি আজ ঝুঁকি না নিই, আগামীকাল গুগল প্রাসঙ্গিক থাকবে না।’ সেই ঝুঁকি নেয়ার সাহসই গুগলকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু ঢাকায় একই সময়ে অনেক সিইও নিজের চেয়ারম্যানকে বলতেও সাহস পাননি যে, একটি ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ। তারা জানেন, চেয়ারম্যানকে না বললেই চাকরির চিঠি চলে আসবে। আর এই নীরবতার কারণেই গত দুই দশকে ব্যাংক খাতের ক্ষতির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে ভারতের ব্যাংকিং খাতে এক কিংবদন্তি নাম আদিত্য পুরি। এইচডিএফসি ব্যাংকের সিইও হিসেবে তিনি ছিলেন কড়া নীতির মানুষ। কোনো প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সুবিধা চাইলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিতেন ‘আমার সিদ্ধান্ত শেয়ারহোল্ডারের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে না।’ বোর্ডকক্ষে তার দৃঢ়তা অনেক সময় তাকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছিল, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সেই নীতি ব্যাংককে শক্তিশালী করেছে। আজ এইচডিএফসি ভারতের সবচেয়ে আস্থাশীল ব্যাংকগুলোর একটি। পুরির গল্প প্রমাণ করে, নেতৃত্ব মানে শুধু চেয়ারম্যানকে খুশি করা নয়, বরং প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেমি ডাইমনও একই শিক্ষা দিয়েছেন। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় যখন প্রায় সব ব্যাংক ধসে পড়ছিল, তখন জেপিমরগ্যান চেজকে বাঁচাতে তিনি কঠিন সিদ্ধান্ত নেন। অনেকেই তখন সম্পদের সত্যিকারের অবস্থা লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু ডাইমন স্বচ্ছতা বেছে নেন। তিনি বিনিয়োগকারীদের সামনে খোলাখুলি সত্য বলেছিলেন। অনেকেই বলেছিল, এতে ব্যাংকের পতন ঘটবে। কিন্তু ঠিক উল্টোটা ঘটেছিল-আস্থা বেড়েছিল, আর তার নেতৃত্বেই জেপিমরগ্যান টিকে যায়।
এসব উদাহরণ সিনেমার দৃশ্যের মতো মনে হলেও এগুলো বাস্তব। আর বাস্তবের সঙ্গে ঢাকার সিইওদের জীবনের পার্থক্য এতটাই তীব্র যে তা বেদনাদায়ক। এখানে সিইওরা সাহস করেন না, কারণ তারা জানেন, একবার চাকরি গেলে আর কোথাও সুযোগ পাবেন না। অথচ একজন যদি দাঁড়াতেন, যদি বোর্ড মিটিংয়ে চেয়ারম্যানকে বলতেন- ‘এই ঋণটা আমি অনুমোদন করব না, কারণ এটা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করবে- তাহলে হয়তো আজ পুরো খাত বদলে যেত।
কল্পনা করা যাক, এক বোর্ড মিটিং চলছে। চেয়ারম্যান গম্ভীর মুখে বললেন ‘এই ফাইলটা পাস করতে হবে।’ সবাই নীরব, শুধু সিইওর দিকে তাকিয়ে আছে। অতীতে তিনি সবসময় মাথা নিচু করে ‘জি স্যার’ বলেছেন। কিন্তু আজ হঠাৎ তিনি মাথা তুললেন। কণ্ঠে কাঁপুনি, তবুও স্পষ্ট উচ্চারণ ‘না। এটা আমি করব না।’ মুহূর্তেই বাতাস ভারী হয়ে যায়। হয়তো তিনি চাকরি হারাবেন, হয়তো কাল থেকে তাকে আরেকটি ব্যাংকও ডাকবে না। কিন্তু সেই একটি ‘না’ বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে প্রথম আলো জ্বালাতে পারে।
কারণ নেতৃত্ব মানে ভয় কাটিয়ে ওঠা। সত্য নাডেলা, সুন্দর পিচাই, আদিত্য পুরি কিংবা জেমি ডাইমন-এরা কেউ ভীরু ছিলেন না। তারা জানতেন, চাকরি হারানো ভয়ংকর নয়, ভয়ংকর হলো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করা।
বাংলাদেশের সিইওদের সামনে এখনও সময় আছে। তারা চাইলে পথ বদলাতে পারেন। হয়তো প্রথম প্রতিবাদীর নাম বিতর্কে ঢেকে যাবে, কিন্তু ভবিষ্যতের ইতিহাসে সেই নাম আলো হয়ে থাকবে। দেশের অর্থনীতি, সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং পুরো প্রজন্মের কাছে তিনি হবেন পথপ্রদর্শক। আর যদি সবাই চুপ করে যান, তবে ব্যাংক খাত ধীরে ধীরে আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে, আর কোনোদিন কেউ জানবেও না যে এই দেশে সিইও নামে কোনো নেতৃত্ব ছিল।
এটাই বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সিনেমাটিক ট্র্যাজেডি। কিন্তু প্রতিটি ট্র্যাজেডির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে পুনর্জন্মের সম্ভাবনা। হয়তো আগামী কোনো এক সকালে কোনো সিইও সাহস করে চেয়ারম্যানকে বলবেন ‘আমার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের প্রতি, আপনার ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রতি নয়।’ সেই দিনের অপেক্ষায়ই আছে পুরো দেশ।
প্রিন্ট করুন









Discussion about this post