Print Date & Time : 15 September 2025 Monday 11:38 am

পর্যটকের দৃষ্টিতে কক্সবাজারের অন্যরকম সীমাবদ্ধতা

মীর রাকীব-উন-নবী : কক্সবাজারের অটোরিকশাওয়ালাদের কোনো নির্দিষ্ট ভাড়া নেই। যার কাছ থেকে যেমন পারে, আদায় করে তারা। আমি একবার শহরের প্রসিদ্ধ ডলফিন মোড় থেকে ৫০ টাকা ভাড়ায় সুগন্ধা বিচ পর্যন্ত গিয়েছিলাম বিকেলের দিকে। পড়ন্ত সূর্যের আলো মন ভরে উপভোগ করে, যখন চারদিক আঁধার হয়ে এসেছিল; তখন ফিরে আসার জন্য একই পথের ভাড়া গুনতে হয়েছিল ১২০ টাকা। বেশিরভাগ অটোরিকশাওয়ালা ১৫০-২০০ হেঁকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল, যেন কিছু বললেই আশপাশের আরও কয়েক অটোরিকশাওয়ালা মিলে ওখানেই একটা ‘মব জাস্টিস’ করে দেবে। এরইমধ্যে কোনো এক দয়াবান এসে ১২০ টাকায় রাজি হয়ে আমায় উদ্ধার করলেন। হেঁটেই চলে আসতে পারতাম কিন্তু অভিজ্ঞতাটা অর্জনের জন্য সেবার বাড়তি পয়সাটুকু গুনেছিলাম।

রিকশায় উঠে চালকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আসার সময় যে ভাড়া ছিল ৫০ টাকা সেটা যাওয়ার সময় কেন ১২০? চালক বলল, ‘আসার সময় ৫০ টাকায় আসছেন বিশ্বাস হয় না মামা।’”

যাব্বাবাহ, বিশ্বাসই করল না! কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছিল না। তারপরও কৌতূহল দমিয়ে রাখতে সংকট হচ্ছিল বিধায় জিজ্ঞেস করেই বসলাম, তোমার কি মানুষের কথা বিশ্বাস না করা অভ্যাস? চালক বলল, না মামা। কিন্তু ৫০ টাকায় কারুর তো আসার কথা না!

হুম। তাহলে আমি কি স্বপ্নে চড়েছিলাম অটোরিকশায়। দ্বিধায় পড়ে গেলাম নিজেই। চালককে জিজ্ঞেস করলাম, কেন কারোর আসার কথা না মামা? সে বলল, একশো-দেড়শো টাকার ভাড়া পঞ্চাশে কেউ আসে মামা? বুঝলাম, ব্যাটার সঙ্গে আলাপ করে লাভ নেই। যতই ঘুরাই আর প্যাঁচাই, সত্যি কথার ‘স’-ও বের হবে না মুখ দিয়ে।

কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্য গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। ভাড়া মিটিয়ে পাশের দোকান থেকে ধূম্রশলাকা কিনছিÑকক্সবাজারে এই আরেক ঝকমারি, ধূম্রশলাকাও যে যেমন পারে তেমন দাম রাখে। গোল্ডলিফ কোনো দোকানে ১৫, কোথাও ১৬, কোথাও ১৭ টাকা শলাকা, আবার বেনসন অ্যান্ড হেজেসের দামও একই রকম। যার কাছে যা পারে রাখে। আর আমার কাছে থেকে সবাই বেশি রাখে।

বিধির বিধান না যা খণ্ডন। ১৭ টাকা দিয়ে একটা শলাকা কিনলাম। একসঙ্গে অনেকগুলো কিনলে একটু কম পড়ত হয়তো। রিকশাওয়ালাকে অপরিকল্পিত পরিমাণ ভাড়া বেশি দিতে হওয়ায়, সে উপায় ছিল না। একটা শলাকাই দোকানদারের মর্জিমাফিক দামে কিনে, তাতে অগ্নিসংযোগ ঘটালাম।

পেছন থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম, যে রিকশায় আমি এসেছি সেই একই রিকশাচালক আবার সুগন্ধার দিকে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় দুজন লোক, সুগন্ধা পয়েন্টে যাবে কি না জিজ্ঞেস করল রিকশাচালককে। চালক বলল, যাবে। ওরা জানতে চাইল, কত? চালক বলল, ষাইট টিয়া দিয়ু। যাত্রীদের একজন বলল, কিল্লাই ষাইট টিয়া দিয়ুম? ফইঞ্চাষ টিয়া। রিকশাওয়ালা রাজি হয়ে গেল।

আমি তখন রিকশাওয়ালার দিকে তাকালাম। চোখে চোখ পড়ল। সেই চোখে কোনো অনুশোচনা বা কিছু দেখলাম না। দেখলাম নীরব উল্লাস। আমার গলা কেটে আমার সামনে দিয়েই গট গট করে বের হয়ে যাওয়ার মতো অণ্ডকোষের জোর তার আছে। সেটি দেখিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আনন্দ অনেকক্ষণ হয়তো তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবে।

আমি ধূম্রশলাকাটি সদ্ব্যবহার করতে করতে ভাবছিলাম, কী ঘটে থাকলে মানুষ এতটা স্বার্থান্ধ হয়ে যায়? এমনকি অপরিচিত বা খদ্দেরদের (যেকোনো রকম কাজের বা ব্যাবসার) সঙ্গেও চোখে-মুখে বুক-পিঠ একাকার করে দিতে বাধে না?

হয়তো দারিদ্র্য তাকে এমনতর মাহাত্ম্য দিয়েছে। বাজারের ঊর্ধ্বমূল্য, মানুষের ক্রমবর্ধমান সর্বগ্রাসী লোভ, জাতিগতভাবে নৈতিকতা বিসর্জনÑকী যে হয়ে থাকতে পারে কারণ কে জানে। ছোট মাথায় ধরল না বেশি। ততক্ষণে ধূম্রশলাকাও শেষ হয়ে এসেছে। পা বাড়ালাম ঘরের পানে।

এবার আর রিকশা ডাকলাম না। কয়েক মাসের জন্য কক্সবাজার থাকা হয়েছিল সেবার। এসব অভিজ্ঞতা সে সময়ই ঝুলিতে ভরেছিলাম। ডলফিন মোড় থেকে বাসার মোড় খালি চোখে দেখা গেলেও, হাঁটতে হাঁটতে প্রায় ৩০ মিনিট পেরিয়ে গেল। পথের দুই পাশে নানা রকমের হোটেল, রেস্তোরাঁ আর বাসের কাউন্টার। সবাই ডাকছে। মামা আসেন, লইট্টা ভাজি, কই যাবেন মামা? কক্স-ঢাকা সিøপার কোচÑভাড়া কম ভাড়া কম ভাড়া কম; কেউ আবার কানের কাছে এসে প্রায় ফিসফিস করে বলছে, রুম লাগবে মামা?”

এরা প্রত্যেকেই জীবনযুদ্ধে লড়ছে! একেকজনের যুদ্ধ একেক রকম। কিন্তু মূল সুর একই। লোক ঠকানো। যে যেভাবে পারছে, যাকে পারছেÑঠকাচ্ছে। আমি এর ভেতরে নিজের জন্য একটা লক্ষ্য ঠিক করেছিলাম, দিনে একবারের বেশি ঠকবো না। বেশিরভাগ দিনই লক্ষ্য ধরে রাখা সম্ভব হতো না। একাধিকবার ঠকে যেতে হতোই। তবে সেদিন যেহেতু সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে এবং বাসার পানে পা বাড়িয়েছি, রিকশা বা কোনোকিছুই নিইনিÑভেবেছিলাম আজ বোধহয় টিকে গেল লক্ষ্যটা। কিন্তু বিধি বাম! গিন্নি ফোন করে বললেন, বাসায় ভাত আর মাংসের সঙ্গে খাওয়ার মতো কিছু নেই। তোমার তো আবার ‘সাইড ডিশ’ ছাড়া চলে না।

আসলেই তা-ই। ছেলেবেলায় মা কখনও এক তরকারিতে ভাত খাওয়াননি। খাইয়ে থাকলে সাইড ডিশ ছাড়াও চলতো। এখন এ বুড়ো বয়সে এসে অভ্যাসটা পাল্টানোরও সাহস পাই না। কি আর করা? সাবধানি মন আর মাথা নিয়ে গেলাম পাড়ার সবজির দোকানটায়। এই সবজি দোকানিপাড়ায় একচ্ছত্র ব্যবসা করেন। আর কোনো সবজির দোকান বসতে দেন না। যদিও তিনি দোকানের পেছনের মাদ্রাসার একজন বড় পৃষ্ঠপোষক। কথায় কথায় একদিন জেনেছিলাম, মাদ্রাসার দুর্দশা তার মনকে ভেঙে-চুরে খানখান করে প্রায়ই। তাই মাদরাসায় যখন যা পারেন, সাহায্য করেন। মূলত আমিও যেন তার এই কার্যক্রমে যোগ দিই, সেই উদ্দেশ্যেই কথাগুলো বয়ান করেছিলেন। টুপি-দাড়ি-পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষের কষ্টে কাতর লোকটি আমার কাছে ছোট আকৃতির একটা করল্লা ৪০ টাকায় বিক্রি করলেন। পরেরদিন বাজার থেকে আমি ১০০ টাকা কেজিতে ৬-৭টা একই আকারের করল্লা কিনে এনেছিলাম। এনে বুঝেছিলাম, আগের দিন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি সংখ্যকবারই ঠকেছি। কম ঠকিনি।

যাক, লেখাটায় ভালো কিছু বিষয়ের অবতারণার ইচ্ছে ছিল। ছেলেবেলায় শুনেছি ইচ্ছে থাকলে নাকি উপায় হয়। উপায়ের খোঁজে লেখার শেষ প্রান্তে পৌঁছেও কিছু পাচ্ছি না।

কক্সবাজারের এই লোক ঠকানোর অর্থনীতি আসলে সেখানকার মানুষদের বাঁচারই লড়াই। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সারভাইভাল টেকনিক’। সবজিওয়ালা বাজার থেকে খুচরা ৫ কেজি সবজি কিনে আনছেন বাজারের দামে। এনে বিক্রি করছেন পিস হিসেবে, তাও নিজের মনগড়া দামে। মুদি দোকানে কোনো জিনিসের দাম নির্ধারিত নেই। এক দোকানে ডিম ১৪০ টাকা ডজন তো আরেক দোকানে ১১০। বেশিরভাগ দোকানে ১৩০ বা ১৩৫। যার কাছে যেমন দাম চাইতে ও রাখতে পারেন তারা। সিগারেট একই। দুধ-কলা-চাল-ডাল-পেঁয়াজ সবকিছুতে একই অবস্থা। শুঁটকিতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। যেহেতু শুঁটকিটা কক্সবাজারের ‘স্পেশাল’, সেহেতু ইচ্ছামতো দাম হাঁকানোর এবং লোক ঠকানোর জায়গাটাও এখানে সবচেয়ে বেশি। আর এসবই ঘটছে কারণ সারাদেশের মানুষ ওখানে বেড়াতে যাচ্ছেন। কয়েকদিনের জন্য ঘুরতে গিয়ে অনেকেই ১০-১৫-২০-৫০-১০০ টাকা নিয়ে ভাবেন না আজকাল। তার ওপর আবার জায়গাটা হয়ে উঠেছে দেশের যতরকমের নৈতিক অবক্ষয়, তার সবকিছুর স্বর্গরাজ্য। চিনিকন্যা-পিতা-পুত্র-মাতাদের দিকে এখানে কেউ তাকানোর নেই। পরকীয়াপ্রেমীদের আটকানোর কেউ নেই। রাজনীতিবিদদের দেখে রাখার কেউ নেই। এমন একটা জায়গায় ছোট ছোট শিশু থেকে শুরু ৯০ পেরোনো বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও যে দুর্নীতিবাজ হবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? কক্সবাজারের তিন মাসে যদি আমি ভালো কিছু দেখে থাকি তাহলে দেখেছি, সেখানকার মারমা, রাখাইন ও চাকমাদের জীবনধরন। নিজেদের যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুতে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন শুধু ওনারাই। সবকিছুতেই। খাওয়া-পরা-বিলাসিতা কোথাও অন্যকে ঠকিয়ে কিছু করার প্রবণতা দেখিনি তাদের মধ্যে।

কিন্তু কি লাভ এসব কথা বলে? ওদের লোভ নেই বলে কি আমাদেরও এখন লোভ-লালসা বিসর্জন করতে হবে? আজকাল যুগটাই তো এমন হয়ে গেছে। মানুষের ভালো কোনো বিষয়ে কারও সঙ্গে কারও মতের মিল নেই। সেসবের চিন্তা বা চর্চার জায়গা নেই। শুধু একটা চিন্তার জায়গায় মিল সবার: ‘তুমি আমার জন্য করেছো, ভালো তো। সেই জন্য আমাকেও তোমার জন্য কিছু করতে হবে কেন? তোমারটা তুমি করেছো। আমি তো তুমি না, তাই না? গলাটা দাও তো সোনা। তাড়াতাড়ি কাটি। রাস্তায় কিংবা মোবাইলে আরও অনেকে গলা দিয়ে বসে আছে। তোমার জন্য সারাদিন কিংবা সারাজীবন নষ্ট তো করতে পারব না।’

 

অতিথি লেখক