শেয়ার বিজ ডেস্ক : দেশের প্রধান নদীগুলোতে পলি জমা, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানিদূষণের কারণে ইলিশ উৎপাদন ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। এতে জাতীয় মাছ ইলিশের দাম সাধারণ ভোক্তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
মৎস্য অধিদপ্তর ৫২টি গুরুত্বপূর্ণ নদীর পয়েন্টে ব্যাপক পলি জমা চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর সোনারচর থেকে নোয়াখালীর ঢালচর পর্যন্ত মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পলি জমে ইলিশের সাগর থেকে নদীতে আসার পথ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
মৎস্য অধিদপ্তর ক্ষতিগ্রস্ত রুটগুলোর তালিকা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে পলি অপসারণ ও নাব্য ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানিয়েছে।
ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্যাহ বলেন, সরকারের সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো মূলত নদীকেন্দ্রিক হলেও সাগরে ইলিশ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ ৬০ শতাংশ ইলিশ সেখানেই ধরা হয়।
ঢাকার ভোক্তারা বলেছেন, বাজার থেকে ইলিশ প্রায় উধাও হয়ে গেছে। অল্প যে মাছ পাওয়া যাচ্ছে, তা রেকর্ড দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি ইলিশ ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পুরান ঢাকার নবাবগঞ্জ বাজারে স্কুল শিক্ষক নুরন্নবী হোসেন বলেন, গত বছর আমি ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে ইলিশ কিনেছিলাম। এখন দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে গেছে।
নিউমার্কেটের মাছ ব্যবসায়ী সানাউল্লাহ মৃধা বলেন, ছোট ইলিশ (৬০০ গ্রামের নিচে) প্রতি কেজি ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, আর মাঝারি আকারের (৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম) ইলিশ প্রতি পিস ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, পাইকারি দামও ব্যাপকহারে বেড়েছে।
সানাউল্লাহ মৃধা বলেন, সদরঘাটে এক মণ (৪০ কেজি) মাঝারি আকারের ইলিশের দাম এখন ৭২ হাজার থেকে ৭৬ হাজার টাকা।
পাইকাররাও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী মো. রমজান আলী জানান, এক কেজির বেশি ওজনের বড় ইলিশ এখন বরিশাল, বরগুনা, কক্সবাজার ও পটুয়াখালীর পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, উপকূলীয় পাইকারি বাজারগুলোতে মাঝারি আকারের ইলিশের দাম কেজিপ্রতি ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৭৫০ টাকা এবং ছোট আকারের ইলিশের দাম কেজিপ্রতি ১ হাজার ১৫০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে ভরা মৌসুমেও পদ্মা ও মেঘনা নদীতে মিলছে না কাক্সিক্ষত ইলিশের দেখা। জেলেরা দিন-রাত নদী চষে বেড়ালেও জ্বালানি খরচ উঠছে না তাদের। এ কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে তাদের। ইলিশ সংকটের কারণে পদ্মা-মেঘনার তীরবর্তী মাছের আড়তগুলোতেও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার পথে। ইলিশের এমন সংকটের কারণ হিসেবে মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, নদীতে চর জেগে ওঠা, তলদেশে খাদ্য সংকট ও নদীর পানি দূষণসহ অন্যান্য কারণে ইলিশের সংকট দেখা দিয়েছে এ বছর।
সাধারণত বছরের জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ইলিশের ভরা মৌসুম থাকে। তবে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসকে বিশেষভাবে ভরা মৌসুম বলা হয়। কারণ এই সময়ে ইলিশ মাছ বেশি পরিমাণে ধরা পড়ে, বিশেষ করে আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমায় এরা ডিম ছাড়ার জন্য সাগরে থাকে।
গত এক সপ্তাহ শরীয়তপুরের পদ্মা-মেঘনার জেলে ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
শরীয়তপুর জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, নড়িয়ার সুরেশ্বর থেকে গোসাইরহাটের কোদালপুর ৪০ কিলোমিটার এলাকা ইলিশের বিশেষ অঞ্চল বলে চিহ্নিত। এছাড়া জেলার ৮০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ইলিশ পাওয়া যায়। জেলায় মৎস্যজীবী রয়েছে ২৯ হাজার ৩৬৭ জন। জেলায় মাছের চাহিদা রয়েছে ২৭ হাজার ৩১৩ মেট্রিক টন। কিন্তু মাছ উৎপাদন হয় ৩০ হাজার ১৯২ মেট্রিক টন। উদ্বৃত্ত থাকে ২ হাজার ৮৭৯ মেট্রিক টন।
বছরে দুবার অর্থাৎ জাটকা এবং মা ইলিশ সংরক্ষণ সময়ে ৭ হাজার ১৫০ জন জেলে পরিবারকে মাসে ৪০ কেজি করে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। এছাড়া এসব জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন উপকরণ দেয়া হচ্ছে। এ বছর ইলিশ উৎপাদন কমে যাওয়ার পেছনে পানি দূষণ, অবৈধ জাল ব্যবহার, অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং জলবায়ু পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য কারণ। নদীর নাব্য সংকট এবং ইলিশের খাদ্যের অভাবও মাছের সংখ্যায় প্রভাব ফেলছে।
শরীয়তপুর জেলা (ভারপ্রাপ্ত) মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কাশেম বলেন, শরীয়তপুরের জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পদ্মা-মেঘনা নদী। এ বছর আমরা লক্ষ্য করছি এবং জেলেদের থেকে জানতে পেরেছি নদীতে ইলিশ সংকট। তবে আমরা আশাবাদী, আমাদের যে মা ইলিশ সংরক্ষণ করার সময় সূচি, তার আগেই নদীতে পর্যাপ্ত সংখ্যক ইলিশ আসবে এবং জেলেরা ইলিশ শিকার করতে পারবেন। এছাড়া নদী দূষণ, নাব্য ইত্যাদি কারণে প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছ উৎপাদন করতে পারে না, ফলে ইলিশ সংকট দেখা দিয়েছে। তবে এখনও যে সময় আছে, তাতে ইলিশ নদীতে আসবে।