Print Date & Time : 21 November 2025 Friday 4:28 am

পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণে কার লাভ কার ক্ষতি

 নাহিদুল ইসলাম : সব অনিশ্চয়তা ও নাটকীয়তার সমাপ্তি ঘটিয়ে অবশেষে ৩৫ হাজার কোটি টাকার পেইডআপ ক্যাপিটাল (পরিশোধিত মূলধন) নিয়ে প্রায় দেউলিয়া হতে যাওয়া পাঁচটি ব্যাংক মার্জার বা একীভূত হতে যাচ্ছে। এই পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন রাষ্ট্রায়ত্ব ইসলামী ব্যাংক গঠনের সব প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক শেষ করেছে। দেশের আর্থিক ইতিহাসে তো বটেই, বিশ্বে এটি একটি বিরল ঘটনা বলছেন আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর জানিয়েছেন এই ব্যাংক হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ফিনান্সিয়াল ব্যাংক। ইতোমধ্যে শক্তিশালী এই ব্যাংকের সিংভাগ (২০ হাজার কোটি টাকা) অর্থ জোগানের ঘোষণা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এজন্য টাকা ছাড়ার জন্য অর্থ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে অর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। নতুন ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হিসাব খুললে সেই হিসাবে টাকা ছাড়া শুরু করবে অর্থ বিভাগ। এছাড়া ১০ হাজার কোটি টাকা আসবে ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স ফান্ড থেকে এবং বাকি ৫ হাজার কোটি টাকা আসতে পারে আন্তর্জাতিক সংস্থা (যেমন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি অথবা আইডিবি) থেকে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কার জানানো হয়ছে, পাঁচ ব্যাংক নয়, বরং সরকারের টাকা পাবে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক নামে গঠিত হওয়া নতুন এই ব্যাংকটি। ব্যাংকটি হবে ইসলামি ধারার ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন।

এই একীভূতকরণের ফলে কেউ লাভবান হবেন, আবার কেউ ক্ষতির সম্মুখীনও হতে পারেন। এই একীভূতকরণের প্রেক্ষাপটে কারা এগিয়ে এবং কারা পিছিয়ে বিভিন্ন মহলে তা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা এবং চুলচেড়া বিশ্লেষণ।

তীব্র আর্থিক (প্রায় এক লাখ কোটি টাকা) সংকটে পড়া পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক (ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক) একীভূত হয়ে একটি নতুন বৃহৎ ইসলামী ব্যাংক গঠন করতে যাচ্ছে। এই পদক্ষেপ মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ব্যাংকগুলোর স্থিতিশীলতা ও আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নেয়া হয়েছে। মেগা মার্জার বা বৃহৎ একীভূতকরণ দেশের ব্যাংকিং খাতে এক নজিরবিহীন ঘটনা। ফলে অর্থনীতি এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।

কারা লাভবান হবেন: একীভূতকরণের মূল উদ্দেশ্যই হলো আর্থিক দুর্বলতা কাটানো এবং একটি বৃহত্তর ও শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। তাই বেশ কয়েকটি পক্ষ প্রাথমিকভাবে লাভবান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ক) আমানতের নিরাপত্তা: সবচেয়ে বড় লাভবান হবেন দুর্বল ব্যাংকগুলোর আমানতকারীরা। দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ব্যাংকগুলোতে টাকা রেখে যারা অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন, নতুন এই ব্যাংকের অধীনে তাদের আমানত সুরক্ষিত হবে।

ব্যাংকিংসেবার ধারাবাহিকতা: ব্যাংক বন্ধ না হয়ে যাওয়ায় গ্রাহকরা স্বাভাবিকভাবেই তাদের লেনদেন ও ব্যাংকিং পরিষেবা চালিয়ে যেতে পারবেন।

নতুন ব্যাংক ব্যাংকিং খাত

শক্তিশালী ভিত্তি: পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ, জনবল, শাখা ও নেটওয়ার্ক একত্র হওয়ায় নতুন ব্যাংকটি একটি বিশাল সম্পদ ও মূলধনের ভিত্তি পাবে। এতে তার আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারেও আস্থা বাড়বে।

খেলাপি ঋণ হ্রাস: একীভূতকরণের প্রক্রিয়ায় দুর্বল ব্যাংকগুলোর খারাপ (খেলাপি) ঋণগুলো আলাদাভাবে ব্যবস্থাপনার সুযোগ তৈরি হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বা (NPL-Non Preforming Loan) হার একটি সহনশীল সীমার (যেমন, ১০ শতাংশের এর নিচে) মধ্যে রাখতে পদক্ষেপ নিতে পারে, যা ব্যাংকটির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করবে।

বাজার দখল: নতুন ব্যাংকটি আকারে বড় হওয়ায় এটি দেশের ব্যাংকিং খাতের একটি বড় অংশ দখল করবে এবং দেশের বৃহত্তর অর্থনীতিতে আরও বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক

আর্থিক স্থিতিশীলতা: দেউলিয়া ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে দেয়ায় আর্থিক খাতে বড় ধরনের ধস বা আতঙ্ক সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি কমবে। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার তদারকির দায়িত্ব সফলভাবে পালনে সাহায্য করবে।

জনগণের আস্থা: ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকি থেকে গ্রাহকদের বাঁচানো গেলে বর্তমান সরকারের (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) ওপর জনগণের আস্থা আরো অটুট হবে।

কারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন: এই একীভূতকরণের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ এবং ঝুঁকি রয়েছে, যা কিছু নির্দিষ্ট পক্ষের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।

কর্মী ছাঁটাইয়ের ঝুঁকি: একীভূতকরণের একটি প্রধান ফল হলো জনবল ছাঁটাই। একাধিক ব্যাংকের শাখা ও বিভাগের কাজ এক হয়ে যাওয়ায় বিপুল সংখ্যক কর্মী অপ্রয়োজনীয় হয়ে যেতে পারেন।

কর্মপরিবেশের পরিবর্তন: কর্মীদের কাজের স্থান পরিবর্তন, পদ অবনমন বা নতুন কাজের চাপের সম্মুখীন হতে হবে। নতুন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে।

দুর্বল ব্যাংকগুলোর শেয়ারের দাম সাধারণত কম থাকে। একীভূত হওয়ার পর নতুন ব্যাংকের শেয়ারের মূল্য কীভাবে নির্ধারিত হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে যাবে ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের মাঝে। ক্ষুদ্র ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা তাদের বিনিয়োগের ন্যায্যমূল্য না পেলে বা তাদের শেয়ারের মূল্য যথেষ্ট কমে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

দুর্বল ব্যাংকগুলোর বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা নতুন কাঠামোতে তাদের ক্ষমতা ও অবস্থান হারাতে পারেন। নতুন বোর্ডের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হবে।

ব্যাংকগুলোর মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণে যারা ছিলেন (বিশেষত এস আলম ও নাসা গ্রুপ) তারা এই একীভূতকরণের ফলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারাবেন এবং ব্যাংকটিতে তাদের প্রভাব অনেকাংশেই কমে যাবে।

দুর্বল ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ আদায়ে শিথিলতা দেখায়। নতুন এই শক্তিশালী ব্যাংক গঠিত হলে তারা খেলাপি ঋণ আদায়ে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে, যার ফলে বড় ঋণখেলাপিরা চাপে পড়ে যাবেন।

পরিশেষে বলা যায়, পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি ‘জীবন রক্ষাকারী’ উদ্যোগ। নিঃসন্দেহে এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন আমানতকারীরা, যাদের অর্থ সুরক্ষিত হবে। একই সঙ্গে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক একটি শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। তবে এই একীভূতকরণের ফলে কর্মীদের চাকরিচ্যুতি, দুর্বল ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের আর্থিক ক্ষতি এবং আগের ব্যবস্থাপকদের ক্ষমতা হ্রাস হওয়ার ঝুঁকি বিদ্যমান। এই প্রক্রিয়া সফল করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বচ্ছতা, কঠোর তদারকি, পুঁজিবাজারে থাকা ব্যাংকগুলোর শেয়ারহোল্ডার বিশেষ করে (ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের) স্বার্থরক্ষা, এবং কর্মীদের পুনর্বাসনের দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। সামগ্রিকভাবে, এটি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।

 

গবেষণা সহযোগী

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেট (বিআইসিএম)