Print Date & Time : 18 August 2025 Monday 1:22 am

পাইপলাইনে তেল সরবরাহ শুরু, বছরে সাশ্রয় ২২৬ কোটি টাকা

স্বরূপ ভট্টাচার্য, চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় সরাসরি জ্বালানি তেল সরবরাহের জন্য নির্মিত পাইপলাইন সফল প্রাক-কমিশনিংয়ের পর আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হচ্ছে গতকাল শনিবার। এর মধ্য দিয়ে দেশের জ্বালানি পরিবহন খাতে নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে। আগে নৌপথে ঢাকায় তেল পৌঁছাতে সময় লাগত ৪৮ ঘণ্টা। এখন পাইপলাইনে লাগবে মাত্র ১২ ঘণ্টা। এতে বছরে সাশ্রয় হবে ২২৬ কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম মহানগরের পতেঙ্গার গুপ্তখালে পদ্মা অয়েল কোম্পানির ডেসপাচ টার্মিনাল থেকে ভূগর্ভস্থ পাইপলাইনের মাধ্যমে সরাসরি জ্বালানি তেল সরবরাহ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। উপদেষ্টার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশনের প্রধান মেজর জেনারেল মুহাম্মদ হাসান উজ জামান প্রমুখ।

ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘মাটির নিচ দিয়ে সরাসরি জ্বালানি তেল সরবরাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে নতুন এক যুগের সূচনা হলো। এই ব্যবস্থায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরাপদে ঢাকায় তেল সরবরাহ করা সম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগে নৌপথে অয়েল ট্যাংকারে তেল পৌঁছাতে ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগত, এখন সময় লাগবে মাত্র ১২ ঘণ্টা। এতে সময় বাঁচবে ৩৬ ঘণ্টা এবং খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি সিস্টেম লস ও চুরিও প্রায় শূন্যে নামবে।’

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কাপোরেশনের উপ-ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) শ্যামল পাল জানান, প্রতিবছর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় প্রায় ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন জ্বালানি পরিবহন করা হতো। এ জন্য প্রতি মাসে ১১০টিরও বেশি অয়েল ট্যাংকারের প্রয়োজন হতো, যা ফতুল্লা ডিপোতে পৌঁছাতে ৪৮ ঘণ্টা সময় নিত। এতে বছরে বিপিসির পরিবহন খরচ হতো প্রায় ৩২৬ কোটি টাকা। পাইপলাইন চালু হওয়ার পর এই খরচ কমে দাঁড়াবে মাত্র ৯০ কোটি টাকায়। বছরে সাশ্রয় হবে প্রায় ২৩৬ কোটি টাকা।

তিনি আরও জানান, পাইপলাইনটির বার্ষিক পরিবহন ক্ষমতা ২ দশমিক ৭ থেকে ৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ভবিষ্যতে তা ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। প্রতি ঘণ্টায় ৩৫০ মেট্রিক টন তেল পরিবহনের সক্ষমতা রয়েছে এই পাইপলাইনের।

পেট্রোলিয়াম ট্রান্সমিশন কোম্পানির উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্ল্যানিং অ্যান্ড অপারেশনস) জামান নাহীদ রায়হান বলেন, ‘আগে নৌপথে তেল পরিবহনের সময় প্রচুর চুরি ও সিস্টেম লস হতো। আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবের কারণেও সমস্যা হতো। পাইপলাইনের মাধ্যমে এসব ঝুঁকি কমে আসবে এবং দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় এটি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।’

তিনি আরও জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রাক-কমিশনিং চলাকালে প্রায় ৫ কোটি লিটার ডিজেল কোনো সিস্টেম লস ছাড়াই সরবরাহ করা হয়েছে। পাইপলাইনের কারিগরি ত্রুটিগুলো সমাধান করা হয়েছে এবং এখন সরবরাহ সম্পূর্ণ নিরাপদ।

প্রকল্প পরিচালক মো. আমিনুল হক জানান, পতেঙ্গা গুপ্তখালের পাশে পাইপলাইন, ডিপো ও রিজার্ভার তৈরি করা হয়েছে। ভূগর্ভস্থ এই পাইপলাইন ২২টি নদী ও খালের নিচ দিয়ে গেছে। পুরো রুটে ৯টি পাম্পিং স্টেশন এবং আধুনিক ডিপো স্থাপন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের নির্মিত ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপলাইন চট্টগ্রাম থেকে ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত।

১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ২৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৩৫০ মেট্রিক টন ডিজেল সরাসরি নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপোতে যাবে।

আমিনুল হক জানান, গত ২২ জুন প্রাথমিকভাবে ঘণ্টায় ২৬০ থেকে ২৮০ মেট্রিক টন তেল পাঠানো হয়। পদ্মা ও মেঘনার পর পাইপলাইনে তেল যমুনার নিচ দিয়ে পৌঁছে গেছে কুমিল্লার ডিপোতেও।

পেট্রোলিয়াম ট্রান্সমিশন কোম্পানি পিএলসি (পিটিসিপিএলসি) ও প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীরা তেল সরবরাহ কার্যক্রম তদারকি করছেন। পতেঙ্গায় স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টা পাইপলাইনের পরিবহন ও নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, বছরে ৫০ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিবহনের সক্ষমতাসম্পন্ন এই পাইপলাইন দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সিস্টেম লস কমাবে, পরিবহন খরচ বাঁচাবে এবং পরিবেশবান্ধব একটি সমাধান হিসেবে কাজ করবে।

প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই পাইপলাইন প্রকল্প থেকে বছরে আয় হবে ৩২৬ কোটি টাকা, আর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হবে ৯০ কোটি টাকা।

এই প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল পর্যন্ত ২৪১ দশমিক ২৮ কিলোমিটার পাইপলাইন এবং গোদনাইল থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত আরও ৮ দশমিক ২৯ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মিত হয়েছে। গোদনাইল-ফতুল্লা অংশে পাইপলাইনের ব্যাস ১০ ইঞ্চি, বাকিটুকু ১৬ ইঞ্চি।

পাইপলাইনটি ২২টি নদীর তলদেশ অতিক্রম করেছে। কুমিল্লার বরুড়ায় ২১ হাজার টনের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ডিপো নির্মিত হচ্ছে, যার জন্য ২৮৬ দশমিক ৮৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

২০১৮ সালে অনুমোদিত ২ দশমিক ৮৬১ কোটি টাকার এই প্রকল্প করোনা পরিস্থিতির কারণে বিলম্বিত হয়ে ২০২৫ সালের মার্চে সম্পন্ন হয়। প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা।

এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের মাধ্যমে।