Print Date & Time : 27 July 2025 Sunday 4:38 pm

পাটকল না থাকায় সর্বোচ্চ ফলনেও হতাশ কৃষক

আসাদুজ্জামান রাসেল, রাজশাহী : রাজশাহীর মাঠে মাঠে এখন এক অন্যরকম ব্যস্ততা। চৈত্র-বৈশাখে বপন করা সোনালি আঁশের পাট এখন কৃষকের ঘরে তোলার প্রতীক্ষায়। প্রাক-মৌসুমে অনাবৃষ্টি ও অতিরিক্ত ব্যয়ের শঙ্কা সত্ত্বেও আষাঢ়-শ্রাবণের স্বস্তিদায়ক বৃষ্টিপাত বদলে দিয়েছে গোটা চিত্র। জমজমাট পাটের গাছ, জলে ভরা খালবিল, কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে পাট কেটে জাগ দেয়াÑসব মিলিয়ে যেন জীবন্ত গ্রামীণ চিত্রকলা। রাজশাহীর পবা, মোহনপুর ও দুর্গাপুর উপজেলার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এবার পাটের ঝলমলে উপস্থিতি। কৃষকরা সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত আঁশ ছাড়ানো আর শুকানোর কাজে। খোদ মাঠেই খুঁজে পাওয়া গেল কৃষকের পরিশ্রম, প্রতীক্ষা ও স্বপ্নের মিশ্র প্রতিফলন।

রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য পাটের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ হাজার ১৮৫ হেক্টর। আবাদ হয়েছে ১৭ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ১২০ দিন মেয়াদি এই ফসল ইতোমধ্যে আষাঢ়ের মাঝামাঝি সময়ে কাটা শুরু হয়েছে, যা শ্রাবণ মাসজুড়ে চলবে।

মৌসুমের শুরুটা ছিল চ্যালেঞ্জিং। ফাল্গুন-চৈত্রে বৃষ্টিহীন খরায় নতুন চারা পড়ে যায় ঝুঁকিতে। অনেক কৃষককে বাধ্য হয়ে সেচ দিতে হয় গভীর নলকূপ থেকে। এতে খরচ বেড়ে যায় প্রায় দ্বিগুণ। তবু পাট জাগ দেয়ার প্রয়োজনীয় পানির অনুপস্থিতি ছিল বড় দুশ্চিন্তার কারণ।

সেই সংকটের অবসান ঘটায় বর্ষার বৃষ্টি। আষাঢ় মাসজুড়ে বৃষ্টিপাতের ফলে খাল-বিল, ডোবা-নালা পানিতে ভরে উঠেছে, যা নিখুঁত পাট জাগ দেয়ার জন্য আদর্শ। এতে পাটের আঁশ হয়েছে দীর্ঘ, নরম, উজ্জ্বল সাদা, যা বাজারে সর্বোচ্চ মূল্যের গ্যারান্টি। পাইকপাড়া গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বৃষ্টির জন্য আমরা মুখ তুলে চেয়েছিলাম। এখনকার পানিতে জাগ দিলে আঁশের মান হবে চমৎকার। যেটা আমরা বলি ‘সাদা-পাট’। এর চাহিদা দেশেও আছে, বিদেশেও।’

উৎপাদন খরচ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। বীজ, সার, কীটনাশক ও শ্রমিক মজুরি সবকিছুর দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। দর্শনপাড়া ইউনিয়নের কৃষক সেলিম রেজা বলেন, ‘এবার এক বিঘা জমিতে আমার প্রায় ১৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কাটা, জাগ দেয়া, আঁশ ছাড়ানো মিলিয়ে শ্রমিক বাবদ খরচ আরও ৬ হাজার টাকা। তবু আশাবাদী তিনি, কারণ ফলন ভালো, আঁশের মানও দারুণ। মণপ্রতি দর ভালো পেলে লাভ হবেই।’

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহীর বিভিন্ন হাটে প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকা দরে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে এখনও পুরোদমে ভালো মানের পাট আসেনি। সেটা এলে দাম আরও বাড়বে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা জানান, এই মৌসুমে পাটের আবাদ ও ফলন দুটোই আশাব্যঞ্জক। অনুকূল আবহাওয়ায় আঁশের গুণগত মান বাড়বে, যার ইতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়বে।

পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এমএ মান্নান জানান, ‘কৃষকরা যদি সঠিক পদ্ধতিতে আঁশ শুকাতে পারেন, তবে বাজারে তাঁরা কাক্সিক্ষত দাম পাবেন। আমরা প্রতিনিয়ত মাঠে গিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিচ্ছি।’

কৃষকের চোখে এখন সোনালি স্বপ্ন। কয়েক মাসের শ্রম ও প্রাকৃতিক বৈরিতার বিপরীতে এসে দাঁড়িয়েছে প্রকৃতির আশীর্বাদÑবৃষ্টি। এবার শুধু দরকার উপযুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা ও ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা। কৃষিপণ্য হিসেবে পাট শুধু অর্থনৈতিক সম্ভাবনার উৎস নয়, বরং পরিবেশবান্ধব বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য এক মূল্যবান সম্পদ।

অন্যদিকে যে পাটকে বলা হতো ‘সোনালি আঁশ’, তা আজ দেশের অর্থনীতির জন্য যেন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের পাট খাত বর্তমানে এক চরম সংকটে। একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অদূরদর্শী নীতিমালার কারণে দেশের সরকারি পাটকলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে পড়ছে। এতে হাজার হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, আর জাতীয় অর্থনীতিতে এক সম্ভাবনাময় খাত হারাচ্ছে তার গৌরব।

১৯৬০-৭০-এর দশকে পাট ছিল বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত। স্বাধীনতার পর জাতীয়করণকৃত ৭৪টি সরকারি পাটকল গত শতকের সত্তরের দশকের শেষদিকে দেশের রপ্তানির প্রায় ৭০ শতাংশ আয় করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাজারে প্লাস্টিক ও সিনথেটিক বিকল্পের আগমনে চাহিদা কমে আসে। এর মধ্যে সরকারি অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং যুগোপযোগী পরিকল্পনার অভাবে একে একে বন্ধ হতে থাকে কারখানাগুলো।

বর্তমানে দেশে কার্যক্রমে থাকা সরকারি পাটকলের সংখ্যা মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি। ২০২০ সালের জুলাই মাসে সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ২৫টি পাটকল একযোগে বন্ধ ঘোষণা করে এবং পরে সেগুলোর বেশির ভাগই বেসরকারি খাতে ইজারা দেয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ মিলই আবার চালু হয়নি।

পরিসংখ্যানে পতনের চিত্র বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যেখানে সরকারি পাটকলগুলো থেকে ১ দশমিক ১৫ লাখ মেট্রিক টন পাটজাত পণ্য উৎপাদিত হয়েছিল, সেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ১৮ হাজার মেট্রিক টনে। পাট চাষেও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বিভিন্ন জেলায় কৃষকরা ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ধীরে ধীরে অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। রাজশাহী, পাবনা, খুলনা, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা এখন পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। একসময় যেখানে দেশের পাট উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশ যেত সরকারি পাটকলগুলোয়, বর্তমানে সেই প্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

রাজশাহীতে পবা উপজেলার কাটাখালীতে অবস্থিত রাজশাহী জুট মিলস ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা হয়। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের অধীন পরিচালিত এই মিলটি একসময় প্রায় ১ হাজার ৭৫৭ শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ২০২০ সালে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এটি বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধের সময় প্রতিশ্রুতি ছিল মাত্র তিন মাসের মধ্যে আধুনিকায়ন শেষে আবার চালু করা হবে। অথচ চার বছর পেরিয়ে গেলেও মিলটি চালু হয়নি, শ্রমিকদের পুনর্বহাল করা হয়নি। এই পরিস্থিতির প্রতিবাদে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে রাজশাহী জুট মিলস শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে শতাধিক শ্রমিক ও স্থানীয় জনগণ বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। তারা দাবি তোলেন, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় অবিলম্বে মিলটি আবার চালু করতে হবে। ওই সমাবেশে সভাপতি মো. জিল্লুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক শামীম হোসেনসহ অন্যরা বলেন, আমরা পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরছি। মিল না চালু হলে কঠোর আন্দোলন হবে।

বাংলাদেশের পাট খাতে দুর্নীতির প্রকোপ দীর্ঘদিন ধরেই নীরবে সক্রিয়। সরকারি পাটকলগুলোর টেন্ডার ব্যবস্থাপনা, কাঁচামালের গুণমান যাচাই, উৎপাদন পরিকল্পনা থেকে শুরু করে শ্রমিক নিয়োগ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই স্বজনপ্রীতি ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণে থাকা পাটকলগুলোয় কর্মরত অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, ভুয়া বিল ভাউচার এবং অনুৎপাদনশীল ব্যয় দেখিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের একাধিক অভিযোগ উঠেছে, যা দুর্নীতি দমন কমিশনের নথিপত্রে রয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের পাট খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে চাই যুগোপযোগী গবেষণা, আধুনিক প্রযুক্তি, স্বচ্ছ নীতিমালা এবং সবচেয়ে বড় কথা রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা। আন্তর্জাতিক বাজারে ইকো-ফ্রেন্ডলি পণ্যের চাহিদা বাড়ছে, সেখানে বাংলাদেশ ‘জুট ফাইবার’ দিয়ে আবারো নিজের জায়গা করে নিতে পারে। তবে এজন্য বন্ধ মিলগুলো আবার চালু করতে হবে, কৃষকদের সহায়তা দিতে হবে, আর শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলার ‘সোনালি আঁশ’ একসময় জাতীয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছিল, আজ তা অবহেলা ও দুর্নীতির করালগ্রাসে পতনের শেষ সীমানায়। রাজশাহীর মতো অঞ্চলে বন্ধ পাটকলের শ্রমিকরা আজ কর্মহীন, পরিবার-পরিজন নিয়ে দুঃসহ দিন কাটাচ্ছেন। অবিলম্বে পাট খাতকে সচল করতে না পারলে এই ঐতিহ্যবাহী খাত শুধু ইতিহাসেই স্থান পাবে, বাস্তবে নয়।