অশোক দত্ত : সিলেটের ভোলাগঞ্জসহ বিভিন্ন কোয়ারি এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চলা সাদাপাথর লুটপাটের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশ ছিল অথবা প্রশাসন নীরব ছিল বলে অভিযোগ তুলেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, এ ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে গতকাল রোববার তিনি বলেন, সরকারের কাজ নীতি প্রণয়ন করা আর সেই নীতি বাস্তবায়ন করবে মাঠ প্রশাসন। ‘আমরা সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নীতি দিয়েছিÑ১৭টি কোয়ারিতে আর কোনোভাবেই পাথর উত্তোলন করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে সেই নীতি বাস্তবায়ন হয়নি। প্রশাসনকে বারবার লিখিতভাবে জানিয়েছি, বলেছি। তারপরও দেখেছি তারা কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বাধ্য হয়েই আমি এবং উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান মাঠে গিয়েছিলাম। আসল উদ্দেশ্য ছিল একটা কঠিন বার্তা দেয়া যে, সরকার আর সহ্য করবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
উপদেষ্টা জানান, তারা মাঠে যাওয়ার পরপরই তিন দিনব্যাপী অভিযান চালানো হয়। পাথর ভাঙার মেশিনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। তবে এরপরই ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। সব রাজনৈতিক দল মিলে এক হয়ে চাপ সৃষ্টি করে বলেÑপাথর তুলতে দিতে হবে। এ সময় পরিবহন মালিকরা ধর্মঘটের হুমকি দেন।
তিনি অতীতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ২০২০ সালের করোনাকালীন সময়েও তারা নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে একাধিকবার পরিবহন ধর্মঘট করেছিলেন। তখন মানুষের দুঃসময় চলছিল, কিন্তু তারা সেই কষ্টের মধ্যে ব্যবসায়িক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছিল। সুতরাং জনগণের স্বার্থ নয়, বরং গোষ্ঠীগত স্বার্থেই আজও এ ধরনের চাপ তৈরি করা হচ্ছে।
রিজওয়ানা হাসানের মতে, এবার সর্বদলীয় ঐক্যই প্রশাসনের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করেছে। তার ভাষায়, ‘আজ দেখা যাচ্ছে, যেসব পাথর লুট হয়েছিল সেগুলো ফেরত আনা যাচ্ছে কীভাবে? এর মানে হলো প্রশাসন হয় শুরু থেকেই চুপ ছিল, নয়তো লুটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। তবে এ ব্যাপারে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেব।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘জনগণই শেষ পর্যন্ত আসল শক্তি। আমরা আক্রান্ত হওয়ার পরই মানুষ প্রতিবাদে নেমেছে। তারা দেখিয়েছে, জনগণ যখন লুটেরাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখন রাজনৈতিক শক্তি যতই তাদের পক্ষে থাকুক না কেন, শেষ পর্যন্ত জিতবে মানুষের শক্তি।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নে মন্ত্রণালয়ের দায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পাথর কতটুকু লুট হলো বা কোথায় গেলÑএটা সরাসরি আমার মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। সরকারের নীতি স্পষ্টÑকোয়ারিগুলোতে পাথর তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সেই নীতি বাস্তবায়ন করবে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন। আমি পরিবেশকর্মী হিসেবে এবং উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিচ্ছি; তবে লুট হয়ে যাওয়ার দায় আমি নেব না।’
তিনি অতীতের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘২০১১ সালে আমি নিজেই পাথর লুট ঠেকাতে মামলা করেছিলাম। ২০১৯ সালে এসব এলাকা ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ তখন থেকে পাথর তোলা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কিন্তু নিয়ম ভঙ্গ করেই পাথর তোলা হয়েছে। শুধু জাফলংয়েই অন্তত ৬৫ জন শ্রমিক বোমা মেশিনে পাথর তুলতে গিয়ে মারা গেছেন। তাদের নিয়ে আজ কেউ কথা বলে না। অথচ এখন বলা হচ্ছে মানুষের জীবিকার কথা চিন্তা করতে হবে।’
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান শেষ কথায় জোর দিয়ে বলেন, ‘যা হোক, বেটার লেট দেন নেভার। জনগণ প্রতিবাদ করেছে, সেটাই আসল শক্তি। এবার থেকে লুটেরা চক্র দুইবার ভাববে, কারণ মানুষ দাঁড়িয়ে গেছে। জনগণের এই ঐক্য ধরে রাখতে পারলে ভবিষ্যতে আর কখনও এ ধরনের লুটপাট ঘটবে না।’
আলাপচারিতায় সাংবাদিকরা বিদেশি মিশন থেকে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানো প্রসঙ্গ তুললে উপদেষ্টা স্পষ্ট করেন, ‘এ বিষয়ে কোনো লিখিত নির্দেশনা নেই। উপদেষ্টা পরিষদেও এমন কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। এর সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্কও নেই।’
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জনের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার ইতোমধ্যেই স্পষ্ট করেছেÑআগামী ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ‘নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরকার সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেই সময় নির্ধারণ করেছে। ফেব্রুয়ারির বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
এ ছাড়া তিনি জানান, আগামী জানুয়ারি থেকেই চীনের সহায়তায় তিস্তা মহাপ্রকল্পের কাজ শুরু হবে। প্রকল্পটি হবে দীর্ঘমেয়াদি, ১০ বছরের জন্য। নদী ভাঙন রোধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখাই এর প্রধান লক্ষ্য।

Discussion about this post