আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. এইচবিএম ইকবাল ছিলেন ঢাকার ত্রাস। শেখ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় ব্যাংকের অনুমোদন নেন। চেয়ারম্যান হয়ে ব্যাংকের কাছে নিজের ভবন ভাড়া দিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। টানা ২৫ বছর ব্যাংকটির নেতৃত্বে থেকে কর্মীদের মারধরসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনেক নির্দেশনাকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। এ নিয়ে দৈনিক শেয়ার বিজ পত্রিকায় ৩ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের শেষ পর্ব ছাপা হলো আজ
শেখ শাফায়াত হোসেন : দি প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ডা. এইচ বি এম ইকবাল ব্যাংকটিকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। এ সময়ে ইকবাল পরিবারের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবা বেশি দামে ক্রয় করতে বাধ্য হতো প্রিমিয়ার ব্যাংক। ঠিক যেভাবে ইকবাল সেন্টার বা প্রিমিয়ার স্কয়ারের নিজেদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ফ্লোর ভাড়া দিয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে উচ্চহারে ভাড়া আদায় করেছেন, তেমনি নিজের প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবা প্রিমিয়ার ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে লাভবান হয়েছে ইকবাল পরিবার। এই আয় থেকে সঠিকভাবে কর দেয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়ম হয়েছে বলে জানা যায়।
দীর্ঘ সময় একই ব্যাংকের পরিচালক বা চেয়ারম্যান পদে থাকলে স্বেচ্ছাচারিতা তৈরি হতে পারে সেজন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে পরিচালক পদে বহাল থাকার মেয়াদ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কোনো কিছুতেই দমেননি ডা. ইকবাল। টানা পাঁচ বছর ব্যাংকের চেয়ারম্যান থেকেছেন। এতে ব্যাংকটিতে তার একক আধিপত্য গড়ে ওঠে। তার ইচ্ছা অনুযায়ী চলে ব্যাংকটি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বছরের পর বছর ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকায় ডা. ইকবালের মালিকানাধীন ভারতীয় চেইন রেস্টুরেন্ট বুখারা রেস্তোরাঁ (প্রা.) লিমিটেড থেকে প্রিমিয়ার ব্যাংকে কর্মীদের অনুষ্ঠানে খাবার সরবরাহ করা হতো। কর্মীদের ট্রেইনিংয়ের জন্য ইকবালের মালিকানাধীন পাঁচ তারকা হোটেল রেনেসাঁতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।
ব্যাংকটির কর্মীদের অভিযোগ, এ ধরনের অনুষ্ঠান ও খাবারের আয়োজন অনেক মনোমুগ্ধকর হলেও এই খরচ কমানো যেত তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী হোটেল ও রেস্টুরেন্টে। তবে সেদিকে নজর না দিয়ে ডা. ইকবালের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে লাভবান করা হয়েছে।
ইকবাল ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ভবনে প্রিমিয়ার ব্যাংকের কার্যালয় করা হয়। উচ্চ হারে ভাড়া আদায়ের তথ্য উঠে আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে। এ নিয়ে শেয়ার বিজ পত্রিকা ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের করা ওই পরিদর্শনে সূত্র ধরে শেয়ার বিজ অনুসন্ধানে নামে। তাতে বের হয়ে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, ইকবাল সেন্টারের মাধ্যমে প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে ৬০০ কোটি টাকারও বেশি অতিরিক্ত ভাড়া এবং পরিষেবা চার্জ আদায় করা হয়েছে। তবে ডা. ইকবালের দাখিল করা আয়কর রিটার্নে তার প্রতিফলন ঘটেনি, যার ফলে প্রদেয় আয়কর এবং ভ্যাটের আনুমানিক ২০০ কোটি টাকারও বেশি ঘাটতি দেখা দেয়।
এর মধ্যে দিয়ে বড় ধরনের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪, ধারা ১৯ এবং ধারা ৩২ অনুযায়ী ভাড়া আদায়ের যথাযথ কর প্রদানের প্রকাশ করা প্রয়োজন।
ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২, ধারা ১৫ অনুযায়ী সংগৃহীত পরিষেবা (নিরাপত্তা, রক্ষণাবেক্ষণ, জেনারেটর, লিফট) চার্জের ওপর ভ্যাট বাধ্যতামূলক। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২, ধারা ২(থ) অনুযায়ী কর ফাঁকি অর্থ পাচারের জন্য একটি পূর্বনির্ধারিত অপরাধ হিসাবে সংজ্ঞায়িত।
এ ধরনের কি কর্মকাণ্ডের কারণে কখনোই ডা. ইকবালের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে।
বরং ব্যাংকের টার্গেট পুরণ করতে না পারায় প্রিমিয়ার ব্যাংকের একাধিক কর্মীকে ইকবাল সেন্টারে ডেকে এনে মারধরের অভিযোগ পাওয়া যায় ইকবালের বিরুদ্ধে। এ ধরনের ফৌজদারি অপরাধেও কখনও ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রিমিয়ার ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে এসব কথা বলেন। তাদের বক্তব্য, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় ডা. ইকবালের কোনো ধরনের জবাবদিহি ছিল না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন প্রিমিয়ার ব্যাংক চেয়ারম্যান।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১ সালের ঢাকায় মালিবাগের রাস্তায় বিএনপির মিছিলে গোলাগুলির ঘটনায় হত্যাকাণ্ডের মামলা থেকেও খালাস পেয়েছিলেন ডা. ইকবাল।
তৎকালীন সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট ও ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল মালিবাগ মোড়ে চারজনকে গুলি করে হত্যার মামলা থেকে আওয়ামী লীগের সাবেক দুই সংসদ সদস্য ডা. ইকবাল ও নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনসহ ১৫ জনকে অব্যাহতি দেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মুখে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশ ছাড়ে ইকবাল ও তার স্ত্রী। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ইকবালের দুই স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শিল্পী ও প্রয়াত মমতাজ বেগম, দুই ছেলে মঈন ও ইমরান এবং মেয়ে নওরিনের হিসাব জব্দ করে।
তবে সেই নির্দেশনা অমান্য করে তার জব্দ হিসাব থেকে টাকা তোলার সুযোগ দিতে বাধ্য হয় প্রিমিয়ার ব্যাংক। এজন্য ওই ব্যাংককেই আবার ১ কোটি ১১ লাখ টাকা এবং ৩০ হাজার ডলারের সমপরিমাণ (প্রায় ৩৬ লাখ ৯০ হাজার) টাকা জরিমানা গুনতে হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইকবাল ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্ত শুরু করে।
ডা. ইকবাল দেশে না থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তার ব্যবহƒত মোবাইল ফোন ও হোয়াসটঅ্যাপে কল দিলেও তাতে সাড়া দেননি কেউ। বার্তা পাঠালেও কেউ উত্তর দেননি।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু জাফরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও ফোনকলে সাড়া দেননি।
এদিকে গত ১৯ আগস্ট ব্যাংকটির আগের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকটিতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ পাওয়া নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ ফরিদুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ব্যাংকটির উন্নয়নে আমাদের নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সে লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করছি ব্যাংকটিতে ঘটে যাওয়া অনিয়ম আর ঘটবে না।’

Discussion about this post