আনোয়ার হোসাইন সোহেল : দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনা, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনার অভাব এবং পুঁজিবাজার সম্পর্কে অনীহার কারণে দেশের আবাসন খাতের অধিকাংশ কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসছে না। ফলে রিয়েল এস্টেট খাতে প্রবৃদ্ধি থাকলেও পুঁজিবাজারে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রায় এক হাজার সদস্য প্রতিষ্ঠান থাকলেও তাদের মধ্যে মাত্র একটি কোম্পানি, ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড (ইএইচএল), এখন পর্যন্ত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারদরের উত্থান-পতন খুবই সাধারণ ঘটনা হলেও, ইএইচএল গত এক বছরে তুলনামূলক স্থিতিশীল অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা যায়, গত ৫২ সপ্তাহে কোম্পানিটির শেয়ারদর সর্বনিম্ন ৬৩ টাকা ৭০ পয়সা এবং সর্বোচ্চ ৯৩ টাকা ৮০ পয়সা ছিল। যদিও তালিকাভুক্তির সময় কোম্পানিটির শেয়ারের ফেসভ্যালু ছিল মাত্র ১০ টাকা। সবশেষ গত বৃহস্পতিবার লেনদেন শেষে প্রতিটি শেয়ারের দর দাঁড়িয়েছে ৭৩ টাকা ৫০ পয়সা।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের মতে, রিয়েল এস্টেট খাতের আকার বড় হলেও কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসতে আগ্রহী নয়। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করছেনÑআর্থিক পরিকল্পনার দুর্বলতা, স্বচ্ছ হিসাব-নিকাশের অভাব, করপোরেট গভর্ন্যান্স বাস্তবায়নে অনীহা এবং সুসংগঠিত দীর্ঘমেয়াদি মুনাফা অর্জনের কৌশল না থাকা। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে লাভ-লোকসানসহ সব তথ্য প্রকাশ করতে হয়, যা ব্যক্তি মালিকানা নির্ভর অনেক কোম্পানি করতে অনিচ্ছুক।
অন্যদিকে, ইএইচএল উদাহরণ হিসেবে দেখাচ্ছে যে পুঁজিবাজারে আসা কোম্পানিগুলো চাইলে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখতে পারে। ডিএসইতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছর ধরে কোম্পানিটি নিয়মিত লভ্যাংশ প্রদান করে আসছে। চলতি বছরও বিনিয়োগকারীদের ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে কোম্পানিটি। এটি ইএইচএলের তৃতীয়বারের মতো ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়া, যা বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানিটির স্থিতিশীলতা ও আর্থিক সক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
রিয়েল এস্টেট খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, পুঁজিবাজারে আসতে হলে কোম্পানিকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কাঠামোতে যেতে হয়, যা অনেক প্রতিষ্ঠান করতে চায় না। বিশেষ করে জমি কেনাবেচা, নির্মাণ ব্যয়, প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন ধাপে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম বা অসংগতি থাকার কারণে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্তির যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। এছাড়া বাজারের অস্থিরতা এবং শেয়ারদর কমে যাওয়ার ভয়ে অনেক উদ্যোক্তা পুঁজিবাজারমুখী হওয়ার সাহস পান না।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আবাসন খাত পুঁজিবাজারে এলে বাজারের গভীরতা বাড়বে, পাশাপাশি বিনিয়োগকারীরাও লাভবান হবেন। এ খাতে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন প্রয়োজন আর ব্যাংকঋণের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ঝুঁকি বাড়ায়। পুঁজিবাজার এই ঝুঁকি কমাতে পারে, যা ইএইচএলের মতো কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে।
এদিকে বিনিয়োগকারীদের অনেকে মনে করেন, ইএইচএলের ধারাবাহিক লভ্যাংশ বাজারে তাদের প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে। নিয়মিত লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার অন্যতম প্রধান উপায়। লভ্যাংশ প্রদানের ধারাবাহিকতা স্বচ্ছ আর্থিক ব্যবস্থাপনার প্রতিফলন, যা অন্যান্য আবাসন কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আসার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে পারে।
এ বিষয়ে ইএইচএল কোম্পানি সেক্রেটারি সেলিম আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, সাধারণত আবাসন কোম্পানির মালিকানায় থাকে একক ব্যক্তি। কিন্তু পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে কোম্পানির বোর্ড ও অ্যাকাউন্টসকে অনেক নিয়ম কানুনের মধ্যে থাকতে হয়, ইন্ডিপেন্ডেন্ট পরিচালক দিতে হয়। সে কারণে অনেকেই শেয়ারবাজারে আসতে চায় না।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভূইয়া শেয়ার বিজকে বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, হয়রানি, এগুলো করতে গেয়ে অনেক সময় নষ্ট হয় এ জন্য অনেকে আসতে চায় না।
এ ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর কমপ্লায়েন্সের ঘাটতি আছে কিনা জানতে চাইলে লিয়াকত আলী বলেন, সারাদেশে প্রায় ৩ হাজারের বেশি আবাসন কোম্পানি আছে। এর মধ্যে আমাদের সদস্য মাত্র ৮৯৪ জন। শুক্রবার ভূমিকম্পনের পর আমরা জরুরি মিটিং করেছি। যেখানে আমাদের কোনো সদস্যের স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হয়। তখন আমরা জেনেছি আমাদের সদস্যদের কারও কোনো স্থাপনার ক্ষতি হয়নি।
রিহ্যাব নির্মিত আবাসনগুলো কতটা ভূ-কম্পন সহায়ক কি না জানতে চাইলেন তিনি বলেন, আমাদের নির্মিত বিল্ডিংগুলো ভূ-কম্পন্ন সহায়ক কি নাÑসে বিষয়ে কোনো সার্ভে নেই। আগামীতে আমরা এটা করব। তবে নিয়মিত অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা রিহ্যাব তা তদারকি করে। এছাড়া বাংলাদেশে ভূমিকম্প সহায়ক রড দিয়ে বিল্ডিং নির্মাণ করে রিহ্যাব।
গত বছরের আবাসন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. সিদ্দিকুর রহমান সরকার বলেছিলেন, রিহ্যাব যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, সেগুলো সরকার অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে। বর্তমানে ভবনের নকশা অনুমোদন ও নির্মাণকাজের জন্য আলাদা নকশা করা হয়। এতে বসবাসের সনদ পেতে সমস্যা হয়। এখন থেকে প্রতিটি পর্যায়েই রাজউকের কর্মকর্তারা যুক্ত থাকবেন।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নীতিগত সহযোগিতা বাড়ানো গেলে এবং কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির জন্য প্রণোদনা দেয়া হলে আবাসন খাতে আরও প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে আসবে। এতে শুধু বাজারই নয়, পুরো অর্থনীতিই উপকৃত হবে।
দেশের আবাসন খাত বর্তমানে দ্রুত বিস্তৃত হলেও পুঁজিবাজারে এর প্রতিফলন খুবই সীমিত। রিহ্যাবের প্রায় এক হাজার সদস্যের মধ্যে মাত্র একটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত থাকা এ খাতের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে ইএইচএল দেখাচ্ছে, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা থাকলে পুঁজিবাজারে সফল হওয়া সম্ভব।
গত ২০২৪ সালে ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রিহ্যাবের আসান মেলায় ৪০৩ কোটি ১২ লাখ ৭৪ হাজার টাকার ফ্ল্যাট, প্লট এবং বাণিজ্যিক স্পেস বিক্রি এবং বুকিং হয়েছে। এর মধ্যে ফ্ল্যাট বিক্রি এবং বুকিং হয়েছে ২৩০ কোটি টাকার। মেলায় প্লট-৯৬ কোটি এবং বাণিজ্যিক স্পেস ৭৭ কোটি ১২ লাখ ৭৪ হাজার টাকার বুকিং এবং বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ব্যাংক কমিটমেন্ট এসেছে প্রায় এক হাজার নব্বই কোটি টাকা। মেলায় ক্রেতা-দর্শনার্থী এসেছেন ১৭ হাজার ৭২৯ জন।
প্রিন্ট করুন










Discussion about this post