নাসরীন জাহান লিপি : পুষ্টি হলো খাদ্য গ্রহণ করার পর সেটি হজম ও শোষণের মাধ্যমে শরীরের বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ এবং শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর ব্যবহার। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় শরীর খাদ্য থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করে এবং তা শরীরের কাজে লাগায়। অর্থাৎ পুষ্টির বেশ কয়েকটি দিক আছে। শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করা। এরপর খাদ্যকে ছোট ছোট অংশে ভেঙে হজম করা। হজমকৃত খাদ্য থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান শোষণ করা। শোষিত পুষ্টি উপাদানগুলোকে শরীরের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা। যেমন—বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ এবং শক্তি উৎপাদন। এতেই কাজ শেষ হয় না। হজম না হওয়া খাদ্য এবং শরীরের বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়া।
পাঠ্যপুস্তকের ভাষায় পুষ্টি নিয়ে এতগুলো কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই, পুষ্টির প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি আবারও মনে করিয়ে দেয়া। শরীরের বৃদ্ধির জন্য পুষ্টি চাই। পুষ্টি শরীরের কোষ ও টিস্যু গঠনে সাহায্য করে, যা শরীরের বৃদ্ধি এবং বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শরীরের ক্ষয়পূরণের জন্য চাই পুষ্টি। শরীর যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন পুষ্টি সেই ক্ষতি মেরামত করতে সাহায্য করে। পুষ্টি শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে, যা বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। সঠিক পুষ্টি গ্রহণ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। পুষ্টির অভাব হলে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন—অপুষ্টি, দুর্বলতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদি। তাই সুষম খাদ্য গ্রহণ করে শরীরে পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা উচিত। এখানেই প্রশ্ন। সুষম খাদ্য গ্রহণ করে শরীরে পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারছে কী দেশের প্রতিটি মানুষ? পারছে না। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই পুষ্টির অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে না।
বাংলাদেশের একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের গড়ে দৈনিক ২৪৩০ কিলোক্যালরি খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার এর সমন্বয়ে প্রতিদিনের খাদ্য খাবারের প্লেট সাজানো উচিত, যেমন খাবরের প্লেটে অর্ধেকটা ভাত, মিক্সড সবজি, ডাল, মাছ বা মাংস বা ডিম এবং শাক সঙ্গে কাঁচামরিচ বা লেবু, খাবার পরে একটা টক বা মিষ্টি জাতীয় ফল খাওয়া যেতে পারে। বেশিরভাগ পরিবারে এরকম সাজানো প্লেট হয় না, সচেতনতার অভাবই সবচেয়ে বড় কারণ। বাংলাদেশের পারিবারিক খাদ্যভাসের কারণে প্রতিদিনের খাবারে অনুপুষ্টি উপাদান কম থাকে কিংবা থাকলেও ঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত না করার কারণে এবং খাবারের বৈচিত্র্যতা কম থাকায় মানবদেহে আয়োডিন, জিংক, ভিটামিন-এ মিনারেল এবং আয়রনের অভাব ব্যাপক হারে বিদ্যমান। বিশেষ করে গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েরা এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ লবণের অভাবে ভুগছেন। বৈশ্বিক পুষ্টি প্রতিবেদন অনুসারে দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ নারী অপুষ্টির শিকার। মায়ের পুষ্টির ঘাটতির প্রভাব শিশুদের ক্ষেত্রেও পড়ে। এতে জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে তাদের নানা সমস্যায় ভুগতে হয়। দেশ বঞ্চিত হয় সুস্বাস্থ্যের অধিকারী নাগরিক থেকে।
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে দেশের প্রতিটি নাগরিকের পুষ্টির বৈষম্য নিশ্চিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে সত্য হচ্ছে সংবিধানে নাগরিকের স্বাস্থ্যের অধিকারের বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা নেই। ভোট বা বাকস্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা হলেও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আলোচনায় নেই। স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে সংবিধানে স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করা উচিত। সরকারের ১৭টি মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে পুষ্টি নিয়ে কাজ করে। পুষ্টিনিরাপত্তায় বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে হলে সবার সমন্বিত এবং টেকসই প্রচেষ্টার প্রয়োজন। পুষ্টির জন্য অন্য খাবারের পাশাপাশি মাছ, মাংস, দুধ প্রত্যেক মানুষের পেতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হলে অতিদরিদ্র মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কৃষিতে অতিরিক্ত কীটনাশক এবং প্রাণীর খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে এমনটা হচ্ছে। পুষ্টি অধিকার নিশ্চিত করতে হলে মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্য আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নেই। প্রাণী অসুস্থ থাকলে মানুষও সুস্থ থাকতে পারে না। দেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও ক্ষুধা নিবারণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হলেও সে তুলনায় পুষ্টিমান অর্জিত হয়নি। বিশেষত দরিদ্র জনসাধারণের পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে খাদ্যে বৈচিত্র্য আনা, ভেজালমুক্ত রাখা ও পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি। আমাদের খাদ্যবিষয়ক আলোচনাগুলোয় সাধারণত খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে কীটনাশকের ব্যবহার করে খাদ্যের পুষ্টিগুণ নষ্ট করে খাদ্যকে অনিরাপদ করা যাবে না। পেট ভরল কি না, খাবারে তৃপ্তি পাওয়া গেল কি না—এসব বিবেচনা না করে খাবারটি কতটুকু পুষ্টিকর, তা দেখার অভ্যেস তৈরি করতে হবে। আমাদের দেশে ভাত প্রধান খাবার। তাতে শর্করার চাহিদা মেটে। কিন্তু সুষম খাদ্য খেতে হলে অন্যান্য খাদ্য উপাদান গ্রহণের বিষয়েও সচেতন হতে হবে। ক্ষুধা দূর হলেও পুষ্টির চাহিদা পুরোপুরি মিটছে কি না দেখতে হবে। অর্থাৎ পুষ্টি অধিকার নিশ্চিত করতে পুষ্টির মান নিশ্চিত করতে হবে এবং এর জন্য নাগরিকদের খাদ্য নিয়ে সচেতন হতে হবে। এ কথা সর্বতোভাবে সত্য যে, দেশে মেগা প্রকল্পে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, স্বাস্থ্যখাতে সেভাবে দেয়া হয়নি। সময় এসেছে পরিবর্তনের। পুষ্টিবিষয়ক মাঠের কাজগুলো মনিটরিং, মূল্যায়ন ও সমন্বয় করতে হবে। পুষ্টি নিরাপত্তায় বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ বাড়ালে শুধু যে অপুষ্টিই দূর হবে তা নয়, জিডিপির প্রবৃদ্ধিও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট (আইওআই) বিষয়ে ডেনমার্কের সংস্থা কনসেনসাস সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা যায়, পুষ্টি খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের ফলে জিডিপি ৩ থেকে ৮ শতাংশ বাড়তে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে পুষ্টি খাতের বিনিয়োগ তুলনামূলকভাবে ভালো থাকলেও আশানুরূপ অগ্রগতি কেন হয়নি? পুষ্টি ও স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন সূচকেও দেখা যাচ্ছে, ফল সন্তোষজনক নয়। কারণ, এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ক্ষেত্রবিশেষজ্ঞ জ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। সিদ্ধান্ত গ্রহণে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দুষ্টুচক্রের প্রভাব থাকে। প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুবিবেচনা, সঠিক নজরদারি ও জবাবদিহির ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে অংশীজনের অংশগ্রহণে সমন্বিত কার্যক্রম নিতে হবে। বৈষম্যহীন ও বিনামূল্যে প্রাথমিক ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য কমিশন গঠন, দলীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত সংসদীয় জবাবদিহি নিশ্চিত করা, অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে নাগরিক, মিডিয়া, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগীদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে সার্বজনীন পুষ্টি অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে পুষ্টি মানুষের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে বেশি জোর দিতে হবে নারী ও কিশোরীদের পুষ্টির উন্নতিতে।
পুষ্টি সচেতনতার লক্ষ্যে তৃণমূল পর্যায়ে সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই। শিল্পকারখানার দূষণ নদী-সমুদ্রে ছড়াচ্ছে। মাছের মধ্যেও মাইক্রো প্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ ও মুনাফালোভী সংস্কৃতি সবাইকে জিঙ্কসমৃদ্ধ চাল খেতে উৎসাহিত করছে। জিঙ্ক ঘাটতি আছে কি না—তা না দেখে এই চাল খাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে সচেতন করতে হবে মানুষকে। সত্যি বলতে কি, তৃণমূলের মানুষকে সচেতন করার ইস্যুর তালিকা করলে তা যথেষ্ট বড় হবে। কত বিষয় আছে কথা বলার! জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো হয় এমন শিশুর সংখ্যা এখনও বেশ কম, মাত্র ৪৬.৬ শতাংশ। কাঁচা মাছ-মাংস, ফলমূল বা শাকসবজি আলাদা রাখতে হবে যাতে এক খাবারের জীবাণু অন্য খাবারে না যেতে পারে। সঠিক তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ধরে ভালোভাবে সেদ্ধ করে খাবার ঢাকনা দিয়ে রান্না করতে হবে। আমরা আশাবাদী হতে চাই। তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানসমূহ, বিশেষ করে গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের জেলা তথ্য অফিসসমূহ ও তথ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় অফিসগুলোর মাধ্যমে তথ্য কর্মকর্তারা সারাদেশে জনসচেতনতা তৈরিতে কাজ করছেন। বাংলাদেশকে পোলিওমুক্ত করতে, মা ও নবোজাত শিশুর মৃত্যু হার কমাতে জনসচেতনতা কার্যক্রম যেভাবে সাফল্য লাভ করেছে, ঠিক একইভাবে পুষ্টিসচেতন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে নিশ্চয়ই।
পিআইডি নিবন্ধ