নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক খাত এখন নতুন এক সংকটে জর্জরিত। রপ্তানি আয়ের শীর্ষ এই খাতে খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, যা শুধু ব্যাংক খাতকেই নয়, পুরো অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক ‘স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন ২০২৪’ অনুযায়ী, গত এক বছরে পোশাক খাতে খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
ঋণখেলাপির অঙ্কে ধাক্কা: ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে তৈরি পোশাক খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৪৮ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৪ দশমিক ০৪ শতাংশ। মাত্র এক বছরে এই খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। আগের বছর খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৭০২ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকদের মতে, এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ব্যাংক খাতের পাশাপাশি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎসও ঝুঁকির মুখে পড়বে।
শিল্প খাতজুড়ে একই প্রবণতা: শুধু পোশাক নয়, টেক্সটাইল, চামড়া, জাহাজ নির্মাণ ও কৃষিভিত্তিক শিল্পেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। বিশেষ করে টেক্সটাইল খাতে খেলাপি ঋণ এক বছরে ১৫ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৫২০ কোটিতে। চামড়া ও জাহাজ নির্মাণ খাতেও ঋণখেলাপির মাত্রা দ্বিগুণের বেশি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২৪ সালের শেষে কেবল উৎপাদনমুখী শিল্প খাতেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেক (৪৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ)।
কেন বাড়ছে খেলাপি: খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ বাজারে শুল্ক-সংকট, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উচ্চ সুদের হার পোশাক খাতের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। তবে আরও বড় সমস্যা হলো, বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা ঋণ নেয়ার পর ফেরত দিচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে এ ঋণের অর্থপাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে।
অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত: অর্থনীতিবিদদের মতে, পোশাক খাতে খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধি শুধু ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতাই নয়, দেশের
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও কর্মসংস্থানকেও হুমকির মুখে ফেলবে। রপ্তানিমুখী খাতে আস্থা না থাকলে নতুন বিনিয়োগ আসবে না, বরং বিদ্যমান শিল্পও সংকুচিত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে ঝুঁকি কমাতে ব্যাংকগুলোর ওপর ঋণ বিতরণে সতর্কতা আরোপের পরামর্শ দিয়েছে। তবে খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, কার্যকর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কড়াকড়ি বাস্তবায়ন ছাড়া খেলাপি ঋণের লাগাম টানা সম্ভব নয়।

Discussion about this post