Print Date & Time : 20 November 2025 Thursday 6:32 pm

প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ছে গ্রামীণ ব্যাংক!

শেখ শাফায়াত হোসেন : নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে গড়ে ওঠা গ্রামীণ ব্যাংক এখন একটি স্বাধীন সত্তা। প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে তিনি ব্যাংকটির সঙ্গে জড়িত নন। তবে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নিয়ে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানটি।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায় ড. ইউনূসের প্রতি একাধিকবার বিদ্বেষ প্রকাশ পায়। ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন আহমদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করার আগে একটি বাহিনীর তরফ থেকে অধ্যাপক ইউনূসকে রাজনৈতিক দল গঠন করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ ধরনের প্রতিহিংসার সূত্রপাত বলে ধারণা করা হয়।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতায় এসে টানা সাড়ে ১৫ বছর সরকারের দায়িত্বে থাকার পর ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। ছাত্রদের অনুরোধে দেশের হাল ধরেন ড. ইউনূস। এরপর থেকে আলোচনায় রয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকও। এতদিন এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানো হলেও এবার শুরু হয়েছে এর অবকাঠামো ধ্বংসের ষড়যন্ত্র।

গতকাল সোমবার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা প্রথম মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে অন্তত ৩টি জেলায় গ্রামীণ ব্যাংকের শাখায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে গত ১৩ নভেম্বরের লকডাউন ঘিরেও আক্রান্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি।

গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আবদুল হান্নান চৌধুরী গতকাল শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এক কোটি আট লাখ সদস্যের এ প্রতিষ্ঠানটি দেশের একটি সম্পদ। ৪০ লাখ নিপীড়িত-বঞ্চিত নারীর এই প্রতিষ্ঠান অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো এ প্রতিষ্ঠানটির ওপর কারও আক্ষেপ থাকা ঠিক না। এর ওপর আক্রমণ করা একটি ভুল মানসিকতার পরিচয়।’

গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষতি হলে তা দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলেও মন্তব্য করেন আবদুল হান্নান চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। নারী সমাজের উন্নয়নে এই প্রতিষ্ঠানের বড় ধরনের অবদান রয়েছে।

প্রসঙ্গত গ্রামীণ ব্যাংকের গোড়াপত্তন ১৯৮৩ সালে। ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূস যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। ২০১১ সালের মে পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ ছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে।

এরপর থেকে নতুন নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘ এই সময়ে (অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত) গ্রামীণ ব্যাংকের পুঞ্জীভূত বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। সারাদেশে ২ হাজার ৫৬৮ শাখার মাধ্যমে এর কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ২৩ হাজার ৯৪০ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে এই ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানে।

গতকাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এর আগের দিন রাতের বেলা থেকে শুরু হয় গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর আক্রমণ। এর মধ্যে বগুড়া ও কিশোরগঞ্জে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখায় আগুন দেয়া হয়। আর পটুয়াখালীতে আগুন দেয়ার চেষ্টা শুরুতেই প্রতিহত করে স্থানীয়রা।

বগুড়ায় রাত ৩টায় আগুন: রোববার দিবাগত রাত ৩টার দিকে বগুড়ার ধুনট উপজেলায় গ্রামীণ ব্যাংকের গোসাইবাড়ী শাখায় আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। আগুনে বারান্দায় থাকা একটি ব্যানারে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেয়া হয়। এতে একটি চেয়ারও পুড়ে যায়। তবে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে তারা প্রস্তুত ছিলেন। আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য বালু ও পানি রেখেছিলেন। নৈশপ্রহরীর পাশাপাশি নিজেরাও জেগে ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘নৈশ প্রহরী বারান্দায় ছিলেন। তিনি কক্ষের ভেতরে যাওয়ার পরপরই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে পেট্রোল ঢেলে বারান্দায় আগুন দেয়া হয়। অগ্নিসংযোগকারীরা মুহূর্তের মধ্যে পালিয়ে যায়। আমরা দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণ করেছি। এ ঘটনায় বিশেষ কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।’

কিশোরগঞ্জে মধ্যরাতে আগুন: কিশোরগঞ্জের শহরের স্টেশন রোড এলাকায় অবস্থিত গ্রামীণ ব্যাংকের যশোদল শাখায় আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গত রোববার রাতে ব্যাংকের নিচ তলায় আগুন দেয়া হয়েছে।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, মুখে মাস্ক পরা এক ব্যক্তি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে অগ্নিসংযোগ করছে। তবে সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের লোকজন আগুন নিভিয়ে ফেলে। আগুনে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন কিশোরগঞ্জ মডেল থানা পুলিশ।

পটুয়াখালীতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা: রোববার রাতে পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের পাশে অবস্থিত সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের ডিবুয়াপুর গ্রামীণ ব্যাংক শাখার পরিত্যক্ত গেটে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। শাখার ভেতরে অবস্থানরত কর্মকর্তারা দ্রুত গিয়ে পানি ঢেলে আগুন নিভিয়ে ফেলেন।

স্থানীয়রা জানায়, রাতে অপরিচিত কয়েকজন ব্যক্তিকে শাখার সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। এর কিছুক্ষণ পর ব্যাংকের গেটে আগুনের ঘটনা ঘটে।

স্থানীয় মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘সকালে এসে শুনি ব্যাংকে আগুন দেয়া হয়েছিল। এরপর খবর পেয়ে পুলিশ আসে এখানে এবং তারা খোঁজখবর নিচ্ছেন।’

ব্যাংকের অফিস সহকারী শেখ বাহাউদ্দিন বলেন, ‘আমি রাত সাড়ে ৮টায় ব্যাংক ত্যাগ করি। রাত ১২টার পর ম্যানেজার স্যার ফোন দিয়ে জানান ব্যাংকে কে বা কারা আগুন দিয়েছে। ভেতরে স্টাফ থাকায় তারা তাৎক্ষণিক পানি দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলেন।’

গ্রামীণ ব্যাংকের ডিবুয়াপুর শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান জানান, ‘রাতে ব্যাংকের ভেতরে ছিলাম আমরা। হঠাৎ সিকিউরিটি গার্ড বাঁশি বাজালে নিচে নেমে দেখি পরিত্যক্ত গেটে আগুন জ্বলছে। দ্রুত সেখানে গিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলি এবং পুলিশকে খবর দিই। এতে কোনো ক্ষতি হয়নি।’

এছাড়া রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া হয়, যাতে ঢাকার মিরপুরে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আগুন লেগেছে বলে দাবি করা হয়। তবে এই ভিডিও যাচাই করে দেখা যায়, তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের মাধ্যমে তৈরি করা।

এছাড়া রোববার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। রাত ৯টার দিকে পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসানের বাসার সামনে, একই সময়ে বাংলামোটর এনসিপি কার্যালয়ের সামনে ও বাড্ডায় একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা।