আলী ওসমান শেফায়েত : প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি, যারা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তাদের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখাটা দুঃখজনক। বছরের পর বছর ধরে এই দাবি উপেক্ষিত হয়েছে, যেন ‘মুলা ঝুলিয়ে রাখা’ হয়েছে। কিন্তু এবার একটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছে এই দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অবসান ঘটানোর। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সাম্প্র্রতিক ঘোষণা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি প্রবাসীদের আস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, ‘নাউ অর নেভার’ এর ভিত্তিতে এই দাবি বাস্তবায়নের এটাই সঠিক সময়।
সিইসি নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন যে, আগামী নির্বাচনে সীমিত পরিসরে হলেও প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন সব প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি স্বীকার করেছেন যে, পৃথিবীর অনেক দেশ ‘আউট অব কান্ট্রি ভোটিং’ শুরু করেও নানা সমস্যার কারণে সফল হতে পারেনি, এমনকি প্রতিবেশী ভারতও এখনও এটি চালু করতে পারেনি। তবে সিইসি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা আমাদের ওয়াদা। সবার দাবিও এটা আমাদের কাছে।’ তিনি দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতা, শিক্ষা এবং রাজনৈতিক সমর্থনকে বিবেচনা করে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলেছেন, যেখানে মানুষের আস্থা এবং কম খরচে বাস্তবায়নের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদও প্রবাসীদের ভোটাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন যে, প্রবাসীরা ভোট দিতে না পারলে ভোটের কাস্ট হারে প্রভাব পড়ে এবং সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশন দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন চান এবং এই উৎসবে প্রবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী।
তবে সিইসি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করিয়ে দিয়েছেন— রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছাড়া কোনো চেষ্টাই সফল হবে না। এই প্রেক্ষাপটে, কমিশনার প্রধান আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ গত ১৫ মে’র মধ্যে সব রাজনৈতিক দলকে প্রবাসী ভোটারদের ভোটদানের পদ্ধতি সম্পর্কে মতামত জানানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই সময়সীমায় রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখা যায়নি।
প্রবাসীদের ভোটাধিকারের দাবি নতুন নয়। নব্বই দশকে এ বিষয়ে হাইকোর্টে একটি মামলা হয়েছিল এবং একজন বিচারপতি প্রবাসীদের ভোটাধিকারের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। দুঃখজনকভাবে, সেই রায় আজো বাস্তবায়িত হয়নি। অতীতের সরকারগুলোর এই অনীহা বোধগম্য নয়, যখন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন দেশে তারা দূতাবাস ও হাইকমিশন ঘেরাও করেছেন, সভা-সমাবেশ করেছেন, এমনকি অর্ধশত প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যে বিক্ষোভ করতে গিয়ে জেল খেটেছেন। গত বছর ৫ আগস্টের আগে মাসব্যাপী রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে তারা তৎকালীন সরকারের টনক নড়িয়ে দিয়েছিলেন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক রিজার্ভে হাত না দিয়েই বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হয়েছে, যা প্রবাসীদের অপরিহার্য ভূমিকা প্রমাণ করে। এমন দেড় কোটি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিককে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই।
পৃথিবীর প্রায় ১৫টি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ আছে যাদের মোট জনসংখ্যা দেড় কোটি হবে না। অথচ বাংলাদেশের দেড় কোটি নাগরিক প্রবাসে থাকেন। এই বিপুল সংখ্যক প্রবাসীদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার দিতে অবহেলা করলে রাষ্ট্রের টেকসই সংস্কার বা মেরামত সম্ভব নয়। তাদের সন্তুষ্ট করলে এবং তাদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করলে তারা আরও কোটি কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে, যার সক্রিয় অংশীজন ছিল এই দেড় কোটি প্রবাসী। এই সরকারের কোনো রাজনৈতিক ব্যাগেজ নেই এবং তাদের অন্য কাউকে খুশি করার প্রয়োজন নেই। এখন তাদের কাছে সুযোগ এসেছে প্রবাসীদের এই ন্যায্য দাবি পূরণ করে নিজেদের সক্ষমতা ও সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়ার।
গত ডিসেম্বরে, ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সঙ্গে প্রবাসীদের একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করেছিল, যেখানে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এই আলোচনায় কমিশন নীতিগতভাবে একমত হয়েছিল যে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা দরকার। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে গোটা নির্বাচন কমিশনও এ ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করে। তাহলে প্রশ্ন হলো, আসন্ন নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে অসুবিধা কোথায়? শুধু প্রয়োজন সত্যিকার সদিচ্ছা, যথাযথ কমিটমেন্ট, প্রয়োজনীয় রিসোর্স এবং যোগ্য লোক। দেশের ভেতরে যোগ্য ও প্রশিক্ষিত লোকবল না থাকলে বাইরের সহায়তাও নেয়া যেতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসকারী অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ আছেন যারা সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে পারেন।
অন্য দেশের প্রবাসীরা তাদের নিজ দেশের নির্বাচনে ভোট দিতে পারলে বাংলাদেশ কেন কার্পণ্য করবে? তুরস্কের বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তুরস্কের প্রবাসীদের ভোট বিজয়ের ক্ষেত্রে একটি ‘ডিসাইসিভ ফ্যাক্টর’ ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা ১৬ লাখেরও বেশি তুরস্কের নাগরিক ভোট দিতে পেরেছিলেন, যার জন্য ফিনল্যান্ড, সুইডেন, কাতার, লেবাননসহ বিভিন্ন দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোলিং বুথ স্থাপন করা হয়েছিল। তুরস্ক যদি তাদের প্রবাসীদের জন্য এত সুন্দর ব্যবস্থা করতে পারে, তবে বাংলাদেশ কেন পারবে না?
ফরাসীরা তাদের প্রবাসীদের ব্যাপারে আরও এক ধাপ এগিয়ে। ফ্রান্সে তাদের প্রবাসীদের শুধু ভোটাধিকারই দেয়া হয়নি, বরং ফ্রান্সের পার্লামেন্টে ১১ জন প্রতিনিধি (এমপি) নির্বাচিত হন শুধুমাত্র প্রবাসে বসবাসরত ফ্রান্সের নাগরিকদের দ্বারা। বাংলাদেশের জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভূমিকা ফ্রান্সের জন্য তাদের প্রবাসী নাগরিকদের ভূমিকার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘ব্লাড সার্কুলেশন’ বলা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং ২০২৪-এর মহান জুলাই বিপ্লবে প্রবাসীদের ভূমিকা ছিল অসামান্য।
এমতাবস্থায় প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের এই ন্যায্য দাবি পূরণে আর কোনো গড়িমসি কাম্য নয়। এটি বাংলাদেশের প্রায় এক দশমাংশ অর্থাৎ দেড় কোটি প্রবাসীর প্রাণের দাবি। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে যেকোনো উপায়ে প্রবাসীদের ভোট দেয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
এইবার যদি প্রবাসীদের ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করা না হয়, তাহলে হয়তো আর কখনও করা হবে না। তাই সব প্রবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে সমস্বরে আওয়াজ তুলতে হবে: ‘নাউ অর নেভার’ আপনাদের এই অধিকার নিশ্চিত করতে আপনাদের পক্ষ থেকে আর কী কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?
মুক্ত লেখক

Discussion about this post