নিজস্ব প্রতিবেদক : আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সুদহার কমতে শুরু করবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে এ ইঙ্গিত দেন।
গভর্নর বলেন, এবারের মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। সে জন্য বেসরকারি খাতের পাশাপাশি মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে আপাতত নজর দিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে এ রকম ভঙ্গি নিয়েই লক্ষ্যগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার মতিঝিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি তুলে ধরেন নির্বাহী পরিচালক এজাজুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান, মো. কবির আহমেদ প্রমুখ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা না থাকলে প্রবৃদ্ধির কথা ভুলে যেতে হবে। টাকা ছাপিয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যায়, তবে সেটা টেকসই হবে না। আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা আনতে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে লেনদেনের ভারসাম্য ও ডলারের দামে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। মূল্যস্ফীতিও কমে আসছে। এখন যে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, এটা অসাধারণ। এর মধ্যে কোনো ভেজাল নেই। বিবিএস যেটা পেয়েছে সেটাই আমরা দিচ্ছি। এই প্রবৃদ্ধির হার পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার প্রবৃদ্ধির চেয়ে ভালো বলেও মন্তব্য করেন গভর্নর।’
আগামী বছর সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করছেন আহসান এইচ মনসুর। তবে এ জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নামলেই নীতি সুদহার কমানো হবে। নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য আগামী ডিসেম্বরে ৭ দশমিক ২ এবং জুনে ৮ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের মুদ্রানীতিতে গত জুনে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
গভর্নর বলেন, ‘দেশে মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমছে। তবে এখনও কাক্সিক্ষত মাত্রায় আসেনি। আমাদের লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি ৩ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা। এটি কমে গত জুনে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে হয়েছে। বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা এবং উৎপাদন ভালো হওয়ায় তা কমছে। চাল ছাড়া সব পণ্যের দর স্থিতিশীল রয়েছে।’
নতুন মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আপাতত প্রধান নীতি সুদহার (রেপো) ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রেখেছে। মূলত ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ধক রেখে রেপোর বিপরীতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয়। অন্যদিকে নতুন মুদ্রানীতিতে আন্তঃব্যাংক ধার বা কলমানি নেয়ার ক্ষেত্রে নীতি সুদহার স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকছে। আর স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) ৮ শতাংশই রয়েছে। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে টাকা রাখার ক্ষেত্রে এ সুদহার প্রযোজ্য হয়। চলতি অর্থবছরের বাজেটে আগামী বছরের জুন নাগাদ গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশ।
সরবরাহের দিক থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, ‘গত বছর ডলারের সংকট থাকলেও আমরা বিদ্যুৎ, সার ও এলএনজির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে আমদানিতে বিঘœ ঘটতে দিইনি। ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রথমে ১২২ টাকা রেট নির্ধারণ করি, পরে বাজারের ওপর ছেড়ে দিই। অনেকে ভেবেছিল তখন রেট ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি।’
ব্যাংক খাতের সংস্কার নিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে একীভূতকরণের পাশাপাশি বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করবে সরকার। পাশাপাশি ব্যাংক পরিচালনায় আসবে কাঠামোগত পরিবর্তন। এমনকি যেসব ব্যাংককে কেন্দ ীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে বারবার সুযোগ দেয়ার পরও অবস্থার উন্নতি করতে পারেনি, তাদের বিরুদ্ধে এবার কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ব্যাংক খাত সারাক্ষণ নজরদারির মধ্যে রাখা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন পরিবর্তন করা হবে, যার জন্য আগামী মাসে প্রস্তাবনা দেবে কেন্দ ীয় ব্যাংক।’
এদিকে সংকোচনমূলক এ মুদ্রানীতি বাণিজ্য-বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এমন শঙ্কার কথা জানায় সংগঠনটি।
ডিসিসিআই বলছে, কড়াকড়ি মুদ্রানীতির প্রভাবে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। জুনের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৬.৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ ধারা অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। চেম্বার মনে করে, ব্যবসায়িক পরিবেশে অনিশ্চয়তা, আইনশৃঙ্খলার চ্যালেঞ্জ, জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি এবং কঠোর মুদ্রানীতির কারণে ঋণ প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী ধারা আরও তীব্র হচ্ছে।
সংগঠনটি আরও জানায়, ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হওয়ার ফলে খেলাপি ঋণ উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায়, যা ব্যাংকিং খাতে মোট বকেয়া ঋণের প্রায় ২৭.০৯ শতাংশ। এ পরিস্থিতি আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ব্যবসায়িক আস্থা কমে যাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিসুদ হার ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রেখেছে; যা ক্ষুদ্র, কুটির, ছোট ও মাঝারি শিল্পসহ উৎপাদনমুখী খাতগুলোর জন্য বড় চাপ তৈরি করছে বলে মনে করে ডিসিসিআই। সংগঠনটির ভাষ্য, দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ সুদের হার উৎপাদন ও বিনিয়োগ খাতে ঋণের ভার বাড়াচ্ছে। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতির গতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে।

Discussion about this post