নিজস্ব প্রতিবেদক : বন্ডের অপব্যবহারকারী ব্যক্তিদের কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন- এমন মন্তব্য করেছেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
গতকাল রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাল্টিপারপাস হলরুমে ‘মিট দ্য বিজনেস’ অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের সভাপতিত্ব করেন।
অংশীজনদের কাছ থেকে তথ্য ও অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য সম্প্র্রতি ‘মিট দ্য বিজনেস’ শীর্ষক আলোচনার উদ্যোগ নেয় এনবিআর। গতকালের এই আলোচনায় গার্মেন্টস, নিটওয়্যার, অ্যাকসেসরিজ, টেক্সটাইল এবং লেদারগুডস খাতের শীর্ষ সংগঠন-বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত এবং রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ), বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং প্রস্তুত এবং রপ্তানিকারক সমিতি (বিজেএপিএমইএ), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এবং বাংলাদেশ লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (এলএফএমইএবি) প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বন্ডের অপব্যবহারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, তাদের কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্ডের অপব্যবহার যারা করে, তারা সমস্যায় পড়ে না। যারা করে তাদের সময়োচিত শাস্তি দিন, প্রয়োজনে তাদের ছবি পত্রিকায় দিতে পারেন। আমরা বন্ড অপব্যবহারকারীদের দেখতে চাই, তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম জানতে চাই। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন। তাদের কারণে আমাদের মতো ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সরকারকে পণ্য আমদানিতে এইচএস কোড তুলে দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বন্ড লাইসেন্সের আওতায় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এইচএস কোড তুলে দেয়ার চিন্তাভাবনা করতে পারেন। যত সমস্যা হয়, ওই এইচএস কোডের কারণে। বছর শেষে আমরা পাই টু পাই হিসাব দিচ্ছি। তাহলে এইচএস কোডের ঝামেলা কেন পড়বে। এইচএস কোডের ভুলের কারণে আবার মিথ্যা ঘোষণার অভিযোগও ওঠে।
সম্প্রতি শেয়ার বিজের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বন্ডের সুবিধার আওতায় তৈরি পোশাক খাতের অনুষাঙ্গিক পণ্য আমদানি করে সেগুলো খোলাবাজারে ছেড়ে দিচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী। মাত্র ১ শতাংশ শুল্কে এসব পণ্য আমদানি করেন তারা। অন্যদিকে প্রচলিত বাজারের জন্য এ ধরনের পণ্য আমদানি করতে ৯৪ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে সাধারণ ব্যবসায়ীদের। ফলে আমদানি পর্যায়ে একই ধরনের পণ্যের দাম বহুগুণে বেড়ে যায়। বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়।
বন্ডেড সুবিধার আওতায় গার্মেন্ট অ্যাকসেসরিজের মধ্যে প্যাকেজিংয়ের কাজে ব্যবহারের কথা বলে রেক্সিন নিয়ে এসে তা খোলা বাজারে ছেড়ে দেয়ায় রেক্সিনের বাজারে এমন অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। ফলে স্থানীয় রেক্সিন উৎপাদক প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের হুমকিতে পড়ে।
অনুষ্ঠানে বন্ডের অপব্যবহারকারীদের তালিকা চান বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান।
এনবিআর চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সুনির্দিষ্ট করে বলবেন, আমাদের কোন কোন সদস্য বন্ডের অপব্যবহার করেন। আমাদের কোনো সদস্য যদি বন্ডের অপব্যবহার করে আমরা তাদের সেবা বন্ধ করে দেব। আমরা আমাদের ২২টি প্রতিষ্ঠানকে ইন্ডিকেশন দিয়ে বলেছি, এসব করবেন না। মুষ্ঠিমেয় কয়েকজনের জন্য পুরো শিল্প দায়ী হবে সেটি আমরা গ্রহণ করব না।’
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘বন্ড লাইসেন্স যাদের নেই তাদের ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে উপকরণ আমদানির সুবিধা দেয়া হয়েছে। এটি যদি কার্যকর করা যায় অন্তত আমাদের ২০০ সদস্য বন্ড লাইসেন্স সারেন্ডার করে দেবে। কারণ বন্ড লাইসেন্স মেনটেন্যান্স করার যে ঝক্কি-ঝামেলা; এটি থেকে অনেকেই রেহাই পেতে চান। বন্ড লাইসেন্স ছাড়া ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে উপকরণ আমদানি করতে পারলে অনেকই বন্ড লাইসেন্স সারেন্ডার করে দেবে।’
কর অব্যহতির ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত হওয়ার বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘কর অব্যাহতির ক্ষমতা এনবিআরের চেয়ারম্যানের থাকবে না। এটির ক্ষমতা অর্থ উপদেষ্টারও থাকবে না। সেটি সংসদে যেতে হবে। এটিকে আমরা সাধুবাদ জানাই। একইসঙ্গে আমরা বলতে চাই, যখন আপনারা কোনো সুবিধা বন্ধ করবেন, সেটাও সংসদে যেতে হবে। চলমান সুবিধা হঠাৎ করে এসআরও দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়, এটি যেন আর না হয়, এই ক্ষমতাও যেন সংসদের হাতে যায়।’
বিজিএমইএ সভাপতি আরও বলেন, ‘আমরা অটোমেশনের পক্ষে। অটোমেশন না হলে দুর্নীতি বন্ধ হবে না। এটি সময়ের ব্যাপার। এটি করতে হবে।
বিজিএমইএ সভাপতি বন্ড লাইসেন্স ব্যবহারকারীদের তালিকা চাইলেও তা দেয়া যায় না বলে উল্লেখ করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। তিনি বলেন, বন্ড কর্মকর্তাদের এক সপ্তাহের ট্রেনিং দেয়া হবে। সেখানে উত্তীর্ণ না হলে তাদের চাকরি করতে সমস্যা হবে। এ সময় অদক্ষ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। বন্ডের পুরো কাজ দ্রুতই অটোমেশন করা হবে। ভবিষ্যতে আর ম্যানুয়ালি বন্ডের কোনো কাজ হবে না।
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, রাজস্ব কর্মকর্তা ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাসহ কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বদলি হওয়ার কারণে ফাইল দীর্ঘদিন আটকে থাকে। ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যাংক গ্যারান্টি নিতে সমস্যা হয়। তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা করার দাবি করছি।
এ সময় বন্ড ব্যবস্থাপনাকে আরও আধুনিক, স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর করতে কাঁচামাল ব্যবহার অনুমতি (ইউপি) ইস্যু প্রক্রিয়ায় ‘কাস্টমস বন্ড ব্যবস্থাপনা সিস্টেম (সিবিএমএস)’ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্তের কথা জানায় এনবিআর।
আলোচনায় আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে সব ইউপি সেবা সিবিএমএসের মাধ্যমে গ্রহণ ও প্রদানের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। এ বিষয়ে এনবিআর শিগগিরই একটি আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা জারি করবে বলে জানা যায়।
এনবিআর জানায়, ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চালু হওয়া স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার সিবিএমএসের মাধ্যমে তিনটি কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটে ২৪টি মডিউলের সাহায্যে বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনলাইন সেবা দেয়া হচ্ছে। তবে ইউপি মডিউল চালু থাকলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এখনও ম্যানুয়ালি ইউপি গ্রহণ করছে। সফটওয়্যারটির ব্যবহার বাধ্যতামূলক না হওয়ায় ১০ মাস পরও কাক্সিক্ষত মাত্রায় পৌঁছায়নি। ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে সিবিএমএসে প্রয়োজনীয় উন্নয়ন ও সংশোধন করে এটিকে আরও ব্যবহারবান্ধব করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এনবিআর।
প্রিন্ট করুন








Discussion about this post