নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও ক্রেতাদের নজর কাড়ছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নিয়মিতভাবে জামদানি রপ্তানি হচ্ছে। এতে একদিকে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়ছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়ে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে।
জামদানি মূলত হাতে বোনা শাড়ি, যা নারায়ণগঞ্জ ও সোনারগাঁও এলাকায় বেশি তৈরি হয়। সূক্ষ্ম নকশা, বিশেষ মোটিফ আর নিখুঁত বুননের জন্য এ শাড়ির আলাদা পরিচিতি রয়েছে। ২০১৬ সালে জামদানি আন্তর্জাতিকভাবে ‘ভৌগোলিক নির্দেশক’ (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর এর চাহিদা আরও বেড়ে যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর কয়েকশ কোটি টাকার জামদানি বিদেশে রপ্তানি হয়। এর বড় বাজার হচ্ছে ভারত। দেশটির নারী সমাজে জামদানি বেশ জনপ্রিয়। পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতারাও জামদানিকে উচ্চমূল্যের পোশাক হিসেবে গ্রহণ করছেন।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে বলিউডেও ছড়িয়ে পড়ে ঢাকাই জামদানির জনপ্রিয়তা। বলিউডের কাল্ট মুভি ‘উমরাও জান’-এ রেখা যে নবাবি শহর লক্ষেèৗতে এক তওয়াইফ বা বাইজির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, তা সিনেমাপ্রেমী মাত্রই জানেন। কিন্তু ‘দিল চিজ কেয়া হ্যায়’ বা ‘ইন আঁখো কি মস্তি’র মতো বিখ্যাত গানের কলির সেই নায়িকাকে যে সিনেমায় ঢাকাই জামদানি পরানো হয়েছিল, তা কজন খেয়াল করেছেন?
এমন তথ্য জানা ছিল না ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহরও। দিল্লিতে বাংলাদেশের জামদানির প্রদর্শনী করার উদ্যোগ নিয়ে কিছুদিন আগে তিনি যখন ‘উমরাও জান’-এর পরিচালক মুজফফর আলির সঙ্গে যোগাযোগ করেনÑপ্রস্তাবটা শুনেই লাফিয়ে ওঠেন বর্ষীয়ান নির্মাতা।
সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে রাষ্ট্রদূত হামিদুল্লাহ বলেন, ‘আমি তো আসবই, আমি ‘উমরাও জান’-এ রেখাকে জামদানি পরিয়েছি। আর দিল্লিতে জামদানি নিয়ে কাজ হলে আমি আসব না?’ শুনে তো আমি যাকে বলে অভিভূত।
দিল্লিতে হস্তশিল্পের সেরা সম্ভার যেখানে প্রদর্শিত হয়, সেই ন্যাশনাল ক্র্যাফটস মিউজিয়াম ও হস্তকলা একাডেমিতে এই সপ্তাহান্তে বাংলাদেশি জামদানির প্রদর্শনীর উদ্বোধনে এসে হইহই করে শাড়ির সম্ভার দেখেছেন, সমঝদারের মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি শাড়ির কাজের তারিফ করেছেন। জামদানি হলো এমন এক বিরল বস্ত্র, যা বুনতে একটা সময় একসঙ্গে দুজন তাঁতি লাগেÑওস্তাদ আর সাগরেদ। কারণ একজনে সে কাজ হয় না। প্রদর্শনীতে সেই বিরল শিল্পশৈলী হাতেকলমে করে দেখাচ্ছিলেন যে তাঁতিরা, সেই যুগলের সঙ্গে মহা উৎসাহে পোজ দিয়ে ছবিও তুলছেন মুজফফর আলি!
ভারতের আর এক বিখ্যাত ইন্টেরিয়র ডিজাইনার সুনীতা কোহলি, যিনি দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত সাজিয়েছেন, তিনিও এই প্রদর্শনীর একজন মেন্টর, বাংলাদেশের জামদানিকে যিনি দিল্লির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। আসলে ভারতের রাজধানীতে বাংলাদেশের জামদানির এত বড় প্রদর্শনী স্মরণকালের মধ্যে তো নয়ই, সত্যি বলতে আগে কখনোই হয়নি।
ক্র্যাফটস মিউজিয়ামের এই প্রদর্শনী অবশ্য ঠিক সরাসরি ক্রেতাদের কাছে বিক্রির জন্য নয়, বরং জামদানি বুননের অনন্য শিল্পটার সঙ্গে ভারতের শাড়িরসিকদের পরিচয় করিয়ে দিতে এবং বাংলাদেশের অনন্য এক শিল্প অভিজ্ঞানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতেই! পদ্মার ইলিশের জোগান যখন নানা কারণে অনিয়মিত, শীতলক্ষ্যা তীরের জামদানি হয়তো বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ভ্যালুকে বৃহত্তর ভারতের সামনে তুলে ধরতে পারবেÑবিষয়টাকে এভাবেও দেখছেন প্রদর্শনীতে আগত অনেকেই। ‘মাছের রাজা’ ইলিশ নাইবা পাওয়া গেল, ‘শাড়ির রানি’ জামদানিতে লোভ তো দেয়াই যায়।
রিয়াজ হামিদুল্লাহ নিজেই বলেন, ‘আমি শাড়ি বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু জামদানির প্রেমে মজে আছি বহু বছর ধরেই!’ ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জে বড়জোর ১৫-২০টা গ্রামেই শুধু হয় আসল জামদানির কাজ। আর এই সব গ্রামগুলোই শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে।
হামিদুল্লাহ বলেন, ‘কিছু তো একটা আছে ওখানকার জলহাওয়ায়। শীতলক্ষ্যার আর্দ্রতা, ওই পানির বিশেষত্ব। ওটা ছাড়া বোধহয় জামদানি বোনা যায় না। এমনকি এই তাঁতিদের অন্য কোথাও উঠিয়ে নিয়ে গিয়েও জামদানি করার চেষ্টা হয়েছে বাংলাদেশেরই অন্য প্রান্তে, বা সীমান্তের অন্য পারেও। কিন্তু হয়ে ওঠেনি সেটা। আর এখানেই জামদানির অনন্যতা, এটা যে শীতলক্ষ্যা তীরেরই ফসল।’
ভারতের রাজধানীতে যমুনার তীর ঘেঁষে ভারত মন্ডপমের এক কোনায় ন্যাশনাল ক্র্যাফটস মিউজিয়ামে বৃহত্তর ভারতের সঙ্গে জামদানির সেই পরিচয়পর্বই চলছে মহাধুমধামে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির ন্যাশনাল ক্রাফটস মিউজিয়ামে প্রথমবারের মতো পাঁচ দিনব্যাপী জামদানি প্রদর্শনী শুরু হয়।
কলকাতার অর্পিতা ভাদুড়ী ‘সুতোর গল্প’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, তিনি ভারতের ক্রেতাদের কাছে ঢাকাই জামদানির পসরা মেলে ধরছেন অনেক দিন ধরে। জামদানি আমদানি করছেন সরাসরি বাংলাদেশ থেকেও।
ভাদুড়ী বিবিসিকে বলছিলেন, আসল ঢাকাই মসলিন এখন অতি দুষ্প্রাপ্য। এক-আধখানা তৈরি হলেও ভারতে তার দাম ২০ লাখ রুপির কম নয়। কিন্তু সে জায়গায় হানড্রেড কাউন্টের রেশম সিল্কের ঢাকাই জামদানির দাম সাধারণের নাগালের মধ্যে, ফলে ‘পুওর ম্যান’স মসলিন’ হিসেবেও তার কদর কম নয়। ভারতে এ ধরনের শাড়ির একটা ভালো বাজার তৈরিও হয়েছে। ঐতিহাসিক কারণেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ জামদানির ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত। ওই রাজ্যের ফুলিয়াতে জামদানির একটি প্রকারভেদ তৈরিও হয়। কিন্তু বাংলার বাইরে ভারতের শাড়িপ্রেমীদের মধ্যে জামদানির নতুন চাহিদা তৈরির অবকাশ আছে বলেও তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশের তাঁতিরা জানান, দু-তিন বছর কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকলেও এ বছর তাদের জামদানি বিক্রি খুব ভালো হচ্ছে। সরাসরি পাইকারি ও খুচরা ক্রেতারা তাদের কাছ থেকে শাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। দামও ভালো মিলছে। সরাসরি ক্রেতার পাশাপাশি তারা ই-কমার্স ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে জামদানি শাড়ি বিক্রির নতুন বাজার হিসেবে ব্যবহার করছেন। দুই মাধ্যম মিলিয়ে এবারের ঈদে তাদের প্রায় ৬০ কোটি টাকার শাড়ি বিক্রির টার্গেট রয়েছে।
তারা আরও বলেন, বর্তমানে পল্লির তাঁতি ও দোকান মালিকদের সবারই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেজ রয়েছে। সেই পেজের মাধ্যমেই তারা শাড়ি বিক্রি করে চলছেন। বেশ সাড়াও পাচ্ছেন তারা। একেকটি শাড়ি দুই হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। তাঁতিদের কাছ থেকে জামদানি কিনে অনেক যুবক অনলাইনে বিক্রি করেও বেশ লাভবান হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জামদানির রপ্তানি সম্ভাবনা অনেক বড়। তবে কিছু সমস্যা রয়েছেÑদক্ষ কারিগরের সংখ্যা কমে যাওয়া, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং বিদেশি বাজারে প্রচার-প্রচারণার ঘাটতি। এছাড়া শুল্ক ও পরিবহন খরচও বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সরকার ও বেসরকারি খাত থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে জামদানির বাজার বাড়াতে। আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ, মান নিয়ন্ত্রণ ও নতুন ডিজাইন তৈরিÑএসবের মাধ্যমে জামদানিকে বৈশ্বিক বাজারে আরও বিস্তৃত করা সম্ভব বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট শিল্পের মতো বড় আকারে জামদানি রপ্তানি না হলেও এটি দেশের অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কারণ হাজারো কারিগরের জীবিকা নির্ভর করছে জামদানি বুননের ওপর। পাশাপাশি রপ্তানির মাধ্যমে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা, যা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে।

Discussion about this post