মো. কাফি খান : আধুনিক আর্থিক জগতে মূলধন, প্রযুক্তি কিংবা অবকাঠামোই কোনো ব্যাংকের একমাত্র শক্তি নয়; প্রকৃত শক্তি নিহিত থাকে দক্ষ মানবসম্পদে। ব্যাংকিং কার্যক্রম যত জটিল ও প্রযুক্তিনির্ভর হচ্ছে, মানবসম্পদের দক্ষতা, সততা, পেশাগত জ্ঞান, নেতৃত্বগুণ ও উদ্ভাবনী চিন্তা তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। একটি সুসংগঠিত মানবসম্পদ উন্নয়ন কৌশল ছাড়া কোনো ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা অর্জন করতে পারে না।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত গত দুই দশকে দ্রুত পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েছে। ডিজিটাল ব্যাংকিং, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা, আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক কাঠামো, গ্রাহকের প্রত্যাশার পরিবর্তন—সব মিলিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন এখন আর ঐচ্ছিক নয়, বরং
অপরিহার্য।
১. মানবসম্পদ উন্নয়নের অপরিহার্যতা
১. প্রযুক্তিগত রূপান্তর
ডিজিটাল ব্যাংকিং, স্বয়ংক্রিয় হিসাব ব্যবস্থা, ব্লকচেইন প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সাইবার নিরাপত্তা—এসব পরিচালনায় দক্ষ মানবসম্পদ ছাড়া ব্যাংক কার্যকরভাবে এগোতে পারবে না।
২. নিয়ন্ত্রক মানদণ্ড পূরণ:
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাসেল নির্দেশিকা, অর্থপাচার প্রতিরোধ কাঠামো, গ্রাহক স্বার্থ সুরক্ষা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন নীতিমালা অনুসরণ করতে হলে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
৩. গ্রাহক প্রত্যাশা পূরণ:
আধুনিক গ্রাহক কেবল ঋণ বা আমানত চান না; তারা চান দ্রুত, স্বচ্ছ, নিরাপদ এবং উদ্ভাবনী সেবা। এর জন্য গ্রাহকমুখী মানবসম্পদ তৈরি অপরিহার্য।
৪. ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও নৈতিকতা:
আর্থিক প্রতারণা, ঋণ অনিয়ম, বাজার ঝুঁকি ইত্যাদি মোকাবিলায় নৈতিক ও দক্ষ মানবসম্পদ ছাড়া ব্যাংকের স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়।
২. বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে মানবসম্পদ উন্নয়নের বর্তমান চিত্র:
বাংলাদেশে মানবসম্পদ উন্নয়ন মূলত তিনটি ধাপে পরিচালিত হয়—
১. ভিত্তিমূলক প্রশিক্ষণ: নতুন কর্মকর্তাদের জন্য সাধারণ ব্যাংকিং, হিসাবরক্ষণ, গ্রাহক সেবা, তথ্যপ্রযুক্তি ও নৈতিকতাবিষয়ক প্রশিক্ষণ।
২. বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ: ঋণ বিশ্লেষণ, বৈদেশিক বাণিজ্য, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, সাইবার নিরাপত্তা ও আর্থিক বাজারে দক্ষতা অর্জনের জন্য মধ্যম ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ।
৩. নেতৃত্ব ও পেশাগত উন্নয়ন: ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে সম্ভাবনাময় কর্মকর্তাদের দীর্ঘমেয়াদি নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ, কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন ও পদোন্নতির প্রস্তুতি।
বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে নানা প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। একই সঙ্গে অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংক নিজস্ব প্রশিক্ষণ একাডেমি গড়ে তুলেছে। তবে সব ব্যাংকে সমান সুযোগ নেই।
৩. আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও কেস স্টাডি:
কেস স্টাডি ১: সিঙ্গাপুর
সিঙ্গাপুরের ব্যাংক খাত মানবসম্পদ উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি সমন্বয় করেছে। ‘ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’-এর আওতায় ব্যাংক কর্মীদের প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ঝুঁকি বিশ্লেষণ ও গ্রাহকসেবা বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এর ফলে সিঙ্গাপুর এশিয়ার অন্যতম প্রতিযোগিতামূলক ব্যাংকিং কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
কেস স্টাডি ২: ভারত
ভারতের স্টেট ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব স্টাফ কলেজ পরিচালনা করছে। এখানে প্রতিবছর হাজার হাজার কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ পান। শুধু ব্যাংকিং নয়, নেতৃত্ব, নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়েও বিশেষ কোর্স চালু আছে। এর ফলে কর্মীরা সমন্বিত ব্যাংকার হিসেবে গড়ে ওঠেন।
কেস স্টাডি ৩: যুক্তরাজ্য
লয়েডস ব্যাংক ডিজিটাল রূপান্তরের সময় প্রায় ৫০ হাজার কর্মীকে অনলাইন প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তারা ইনোভেশন ল্যাব গড়ে তুলে কর্মীদের উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা কাজে লাগিয়েছে। ফলে গ্রাহক আস্থা ও ব্যাংকের আর্থিক সাফল্য উভয়ই বেড়েছে।
কেস স্টাডি ৪: মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়ার ব্যাংকিং খাত ‘সেন্ট্রাল ব্যাংক ট্যালেন্ট ম্যানেজমেন্ট ইনিশিয়েটিভ’ চালু করেছে। এর মাধ্যমে ব্যাংক কর্মকর্তাদের দীর্ঘমেয়াদি কর্মপথ তৈরি হয়; যা ব্যাংকিং ক্যারিয়ারকে স্থায়ী ও আকর্ষণীয় করে তোলে।
৪. বাংলাদেশের অগ্রগতি ও সীমাবদ্ধতা:
অগ্রগতি:
হ প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের সংখ্যা ও বিষয়বস্তু বেড়েছে।
হ প্রযুক্তি ব্যবহার ও সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
হ কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা আনতে প্রচেষ্টা চলছে।
সীমাবদ্ধতা:
হ সব ব্যাংকে প্রশিক্ষণের সমান সুযোগ নেই।
হ অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকে, বাস্তবে প্রয়োগ হয় না।
হ নেতৃত্ব উন্নয়ন এখনও সীমিত পর্যায়ে।
হ কর্মীদের অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতি দুর্বল।
হ দক্ষ মানবসম্পদ বিদেশে চলে যাওয়ার প্রবণতা।
ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
প্রিন্ট করুন










Discussion about this post