সেলাইয়ের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যাগ তৈরির শিল্পোদ্যোগে সাফল্য পেয়েছেন এস এম শাকিব হাসান। পোশাকের পরই যে পণ্যটির ব্যাপক চাহিদা দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এবং একাডেমি ও করপোরেট লাইফে; সেই ব্যাগ উৎপাদনেই পারদর্শিতা পেয়েছে তার গড়া আরএমএস করপোরেশন। এসকেপ নামে নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করে স্থানীয় ও বৈশ্বিক বাজারে নতুন সম্ভাবনা দেখছেন শাকিব হাসান। একান্ত আলাপচারিতায় সবিস্তার তুলে এনেছেন নূরউদ্দিন রানা
শেয়ার বিজ: একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় পদ ছেড়ে শিল্পোদ্যোক্তা হয়ে কেমন উপভোগ করছেন?
এস এম শাকিব হাসান: বহুমুখী কাজ ও শত ব্যস্ততায় সময় কাটানোর পরও এখন আর ক্লান্তি অবসাদ ছুঁতে পারে না আমাকে। আগে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডকে দেশের বাজারে বিপণনের দায়িত্ব পালন করতাম। এখন নিজের তৈরি পণ্য ও ব্র্যান্ড নিয়ে যাচ্ছি বৈশ্বিক বাজারে। সেই সঙ্গে ক্রমান্বয়ে দখলে আসছে স্থানীয় বাজার।
শেয়ার বিজ: এমন অনুভব ও উপলব্ধির কারণ জানতে পারি কি।
শাকিব হাসান: চাকরি জীবনে আমি ‘করপোরেট লাইফ’ লিড করতাম। শুরুতে স্মার্ট টেকনোলজি বিডি, এরপর এক্সিকিউটিভ টেকনোলজিস এবং সর্বশেষ কান্ট্রি কনসালট্যান্ট হিসেবে এসার ইন্ডিয়ার দায়িত্বে ছিলাম। এই সময় পর্যাপ্ত অর্থ, দেশ-বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ ও উন্নত আবাসন ব্যবস্থা; সবই ছিল আমার। একসময় উপলব্ধি হলো, আমি কেবল নিবেদিত অন্যের স্বপ্ন নির্মাণে।
শেয়ার বিজ: এরপরই উদ্যোক্তা হয়ে গেলেন আপনি।
শাকিব হাসান: গভীর উপলব্ধি আমাকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলেছিল। নিজেকে নিজের মতো প্রস্তুত করার পরিকল্পনা করলাম। জীবন সঙ্গিনী উম্মাহ নাজিয়া রাশা খানে সমর্থন পেলাম। অতঃপর করপোরেট ক্যারিয়ার ছেড়ে ২০২১ সালে নিয়ে গড়ে তুলি এসএমএস করপোরেশন।
শেয়ার বিজ: সহ-উদ্যোক্তা সম্পর্কে জানাবেন কি?
শাকিব হাসান: আমার সহধর্মিণী ও সহ-উদ্যোক্তা উম্মাহ নাজিয়া রাশা খান সিয়াম ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ এবং কার্বন ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ থেকে এমএসসি সম্পন্ন করেছেন। তিনি স্থানীয় ও থাই কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনায় সাত বছরের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। সবশেষ তিনি সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানিতে (এসএমসি) ডেপুটি ম্যানেজার ছিলেন। উদ্যোক্তা হিসেবে তাকে পাশে পাওয়াটা আমার জন্য সৌভাগ্যের। আমাদের প্রডাক্টিভিটি আরএসএম করপোরেশনের সমৃদ্ধিতে কাজে লাগছে।
শেয়ার বিজ: এসএমএস করপোরেশন? উৎপাদন প্রক্রিয়ার কোন খাতে কেন বিনিয়োগে এলেন?
শাকিব হাসান: সেলাইয়ের ক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয়েছিল এসএমএস করপোরেশন। তৈরি পোশাক শিল্প দেশে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে অবদান রাখছে। সুঁই-সুতোর বুননে শিল্পায়ন এবং জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছে পোশাক শিল্প। আমরা বেছে নিয়েছি, পোশাকের পরের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ব্যাগস; যা দৈনদিন জীবনযাত্রা, একাডেমি ও করপোরেট লাইফের অন্যতম অনুষঙ্গ। আমি এবং আমার স্ত্রী রাশা, ২০২১ সালে দুটি মেশিন নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলাম এবং এখন আমাদের ১২০ জনেরও বেশি কর্মী রয়েছেন। আরএমএস করপোরেশন ল্যাপটপ ব্যাগ, স্কুলব্যাগ, স্পোর্টস ব্যাগ এবং করপোরেট ব্যাগ থেকে শুরু করে ব্যাকপ্যাক তৈরিতে বিশেষজ্ঞ।
শেয়ার বিজ: উৎপাদনের বহুবিধ খাত থাকলেও ব্যাগ শিল্পে বিনিয়োগ করলেন?
শাকিব হাসান: করপোরেট লাইফের একটি অভিজ্ঞতা আমাকে ব্যাগ উৎপাদনে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি স্মার্ট টেকনোলজিস-এ প্রমোশনাল একটি প্রোগ্রামের জন্য প্রচুর ব্যাগের অর্ডার করেছিলাম। কিন্তু অনুষ্ঠানের সময় অতি নিকটবর্তী হলে সরবরাহকারীর কারখানা পরিদর্শনে যাই এবং গিয়ে দেখি তারা তখনও আমার কার্যাদেশের ব্যাগ উৎপাদনই শুরু করেনি। অথচ অনুষ্ঠানে এই পণ্যটি ছিল আমাদের গিফট আইটেম। সেই কঠিন পরিস্থিতি বহু প্রচেষ্টায় সামাল দেয়া হয়। তখন মনে হলো, পোশাকের প্রচুর ব্র্যান্ড থাকলেও ব্যাগস-এর স্থানীয় বিশেষ কোনো ব্র্যান্ড নেই। এই উপলব্ধি থেকে, ব্যাগস উৎপানের ধারণাকে প্রাধান্য দিই।
শেয়ার বিজ: এখন কী ধরনের ব্যাগস তৈরি করছেন?
শাকিব হাসান: পোশাক ও জুতা-মোজা পরিধানের পর স্কুল, অফিস কিংবা ভ্রমণ; যেই উদ্দেশ্যেই আমরা বের হই, তখনই চাহিদার অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে ব্যাগস। যেমন- স্কুলব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, মেসেঞ্জার ব্যাগ, পাসপোর্ট ব্যাগ, ক্রস বডি ব্যাগ, ক্যারি ব্যাগ, সাইড ব্যাগ, জিম ব্যাগ, টোট ব্যাগ ও ডেলিভারি ব্যাগ ইত্যাদি রয়েছে। আরএমএস করপোরেশন শুরু থেকে কোম্পানি, স্কুল এবং ইভেন্টের জন্য কাস্টমাইজড ব্যাগ তৈরি করে থাকে।
শেয়ার বিজ: কী উপাদানে তৈরি হয় আপনাদের ব্যাগ? কোন ব্র্যান্ড নামে বাজারজাত করছেন?
শাকিব হাসান: ব্যাগ তৈরিতে আমরা পলিয়েস্টার ফেব্রিক, লাইনিং, নাইলন জিপার, মেটাল রানার, নাইলন টেপ এবং কিছু পিই ফোম ব্যবহার করি।
এসকেপ (ঊঝঈঅচঊ) ব্র্যান্ড নামে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করছি আমরা। প্রতি মাসে আমরা ৩০ থেকে ৪০ হাজার ইউনিট উৎপাদন করে থাকি। আমাদের পুরো উৎপাদন সক্ষমতায় ৬০ হাজারের অধিক ব্যাগস তৈরি সম্ভব। বর্তমানে আমাদের পণ্য লাইনে বিভিন্ন পণ্যের স্টক কিপিং ইউনিট (এসকেইউ) রয়েছে ২০-এর অধিক।
এখন লক্ষ্য হলো দেশের জন্য একটি স্থানীয় ব্যাকপ্যাক ব্র্যান্ড তৈরি করা, যা গণমানুষের চাহিদা পূরণ করবে এবং আমাদের ব্র্যান্ডে এসকেপ ব্র্যান্ডের বৈশ্বিক বাজার সম্প্রসারণ করা।
শেয়ার বিজ: ব্যাগ শিল্পের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
শাকিব হাসান: পাঁচ বছরের কম সময়ে যতটা সাড়া পেয়েছি তাতে অভিভূত আমরা। প্রায় ২০ কোটি মানুষের একটি সমৃদ্ধ বাজার রয়েছে এখানে। পর্যবেক্ষণ করে দেখছি, প্রতি এক বছর পর মানুষ পুরোনো ব্যাগটি পাল্টে ফেলে। অর্থাৎ অল্টারনেট ইয়ারেই একটি ব্যাগের চাহিদা প্রতিটি স্কুলগামী, কলেজগামী, বিশ্বব্যিালয়গামী, চাকরিজীবী, স্পোর্টসম্যান, ট্রাভেলার; সবাই নতুন ব্যাগের চাহিদা অনুভব করেন। ইতোমধ্যে আমরা বাংলাশে নৌবাহিনী এবং সামরিক বাহিনীতে ইউনিফর্ম, উপকরণ এবং বেশিরভাগ ক্রয়ের চাহিদা সরবরাহের সঙ্গেও জড়িত। আমরা বাংলেোশ ব্যবসা করতে ইচ্ছুক বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য ব্যবসায়িক সহায়তাও করি।
শেয়ার বিজ : বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ করতে পেরেছেন কী?
শাকিব হাসান: বর্তমানে আমাদের লক্ষ্য হলো, বিভিন্ন করপোরেট হাউস, আইটি কোম্পানি, ফার্মা, ব্যাংক, একাডেমির জন্য ব্যাগ তৈরি। ইতোমধ্যে স্পেন ও থাইল্যান্ডে এসকেপ ব্র্যান্ডের ব্যাগ রপ্তানি করেছি। এসকেপ ব্র্যান্ডকে বৈশ্বিক ব্র্যান্ডে পরিণত করতে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন ফ্যাশন ফেয়ারে অংশ নিচ্ছি। ক্রেতারাই এসকেপ-এর নাম ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে গিফট আইটেম হিসেবে এসকেপ-এর ব্যাগস বেশ সমাদৃত।
শেয়ার বিজ: এসকেপ ব্যাগস এর বিশেষত্ব কী?
শাকিব হাসান: ক্যামেলব্যাক মাউন্টেন এবং মাউন্ট আরভনের মতো আমাদের পণ্য ভ্রমণপিপাসুদের চাহিদা মাথায় রেখে ডিজাইন করা হয়েছে। এই ব্যাগগুলোয় সৃজনশীল নকশা, একাধিক বগি এবং জল-প্রতিরোধী কাপড় রয়েছে; যা নিশ্চিত করে, আবহাওয়া যা-ই হোক না কেন আপনার জিনিসপত্র নিরাপ এবং শুষ্ক থাকবে।
আপনি হাইকিং ট্রিপে যাত্রা করছেন, ক্যাম্পিং করছেন, অথবা কেবল শহর ঘুরে দেখছেন, আপনার অ্যাডভেঞ্চারে আপনার সঙ্গে থাকার জন্য এসকেপ ব্যাগস-এর কাছে রয়েছে বহুবিধ ব্যবহারের নিখুঁত ব্যাগ। স্টাইল এবং কার্যকারিতা’সহ বৈশ্বিক ভ্রমণে এসকেপ ব্যাগস হবে লাগসই ও রুচিশীল।
শেয়ার বিজ: দুুটি মেশিন ও দুজন সেলাইকর্মী নিয়ে শুরু করেছিলেন আপনি?
শাকিব হাসান: শুরুতে ছিল দু’জন, এখন ১২০-এর অধিক সেলাই কর্মী নিবিড়ভাবে যুক্ত আছেন আমাদের সঙ্গে। এছাড়া অফিস ও ফ্যাক্টরিতে আরও বেশ ক’জন সাপোর্ট স্টাফ আছে। আমরা শুরু করেছিলাম স্বামী-স্ত্রীতে। এখন তাতে যুক্ত হয়েছেন আমার বড় ভাই। এখন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিযোগিতা সক্ষম মনে করছি এবং আগামীদিনে বৈশ্বিক বাজারে সগৌরবে বিচরণ করতে পারব আশা করি। এসকেপ ব্যাগস হবে বাংলাদেশের বৈশ্বিক ব্র্যান্ড।
রপ্তানিতে তৈরি পোশাক শিল্পে একক নির্ভরতা ভাঙতে সক্ষম হবে ব্যাগস শিল্প। আশা করি, ভবিষ্যতে ব্যাগস তৈরিতে এগিয়ে আসবে নতুন নতুন উ্েযাক্তা। ব্যাগ শিল্প হবে পোশাকের পর বাংলদেশের সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।
শেয়ার বিজ: আপনারে সাফল্য কামনা করছি। মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
শাকিব হাসান: ধন্যবাদ আপনাকেও।

Discussion about this post