ড. মতিউর রহমান : আমরা এমন এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছি, যেখানে মানব-অস্তিত্বের পুরোনো সংজ্ঞাগুলো দ্রুত বদলে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের (4IR) ঢেউয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), জৈব-প্রযুক্তি ও রোবটিকস আমাদের সামাজিক কাঠামো, অর্থনীতি ও ব্যক্তিপরিচয়কে নতুন করে গড়ে তুলছে। জৈবিক, ডিজিটাল ও প্রযুক্তিগত জগতের মধ্যকার সীমানা ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে এবং এই পরিবর্তনগুলো আমাদের মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয়কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
এই প্রেক্ষাপটেই সমাজতত্ত্বে জন্ম নিয়েছে এক নতুন এবং বিপ্লবী চিন্তাধারা—পোস্ট-স্পিশিজ সমাজতত্ত্ব (Post-Species Sociology)। এই তত্ত্বটি মানুষের একচ্ছত্র আধিপত্যের ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ, প্রযুক্তি ও অন্যান্য অ-মানুষের সহাবস্থানকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে। যদিও এই পরিভাষাটি এখনও মূলধারার একাডেমিক আলোচনায় পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত নয়, তবে স্টিভ ফুলার, ডোননা হ্যারাওয়ে এবং ইউকুই হুই-এর মতো দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের কাজ এই চিন্তাধারার শক্তিশালী বৌদ্ধিক ভিত্তি স্থাপন করেছে।
বিশেষত, স্টিভ ফুলারের ‘Humanity 2.0: What it Means to be Human Past, Present and Future (2011)’ গ্রন্থটি আধুনিক সমাজ ও প্রযুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে মানব-অস্তিত্বের মূল প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করে। এই বইটি এমন এক সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল, যখন প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, বিশেষ করে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং সাইবর্গের মতো ধারণাগুলো মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছিল।
ফুলার এই বইটিতে এই প্রশ্নটি তোলেন যে, বিংশ শতকের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভিত্তিগুলো কি একবিংশ শতাব্দীর মানুষের জন্য যথেষ্ট? তিনি মনে করেন, আমাদের মানব হওয়ার সংজ্ঞাটি আর কেবল জৈবিক বা প্রাকৃতিক বিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি এখন আমাদের নিজেদের তৈরি প্রযুক্তির দ্বারা পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হচ্ছে। ফুলার এই ধারণাকেই ‘Humanity 2.0’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এই বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য হলো যে মানুষ কেবল নিও-ডারউইনীয় বিবর্তনের ফল নয়, বরং আমরা নিজেদের ইচ্ছাকৃতভাবে উন্নত করার জন্য চেষ্টা করি। ফুলার এই প্রক্রিয়ায় ধর্ম, দর্শন ও সামাজিক বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক ভূমিকা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ধর্মীয় ধারণাগুলো, যেমন ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবিতে মানুষ সৃষ্টি, মানুষকে নিজেদের উন্নত করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে। এই ধারণাগুলিই পরবর্তী সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টার জন্ম দিয়েছে।
ফুলার মনে করেন, ট্রান্সহিউম্যানিজম (Transhumanism) এবং পোস্টহিউম্যানিজমের (Posthumanism) মতো আধুনিক ধারণাগুলো সেই ঐতিহাসিক প্রবণতারই ধারাবাহিকতা। তিনি সমাজবিজ্ঞানকে এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটিকে বোঝা এবং পরিচালনা করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে দেখেন। এই বইটিতে তিনি যুক্তি দেন যে, এই নতুন মানব-অস্তিত্বের সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করা এবং এর সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরি।
ফুলারের এই বইটি শুধু মানবপ্রকৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করে না, বরং এটি একটি সতর্কতা হিসেবেও কাজ করে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যখন আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের উন্নত করি, তখন আমরা কি আমাদের মানবতাকে হারাচ্ছি? যখন আমাদের শরীর এবং মন প্রযুক্তির সঙ্গে মিশে যায়, তখন আমরা কে? এই ধরনের প্রশ্নগুলো উত্থাপন করে ফুলার মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য একটি সচেতন এবং দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গির আহ্বান জানান। তার মতে, আমাদের কেবল প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে গেলেই হবে না, বরং আমাদের সামাজিক, নৈতিক ও দার্শনিক দিকগুলোও বিবেচনা করতে হবে।
প্রচলিত সমাজতত্ত্বের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হলো মানবসমাজ। এর আলোচনা মূলত মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে ঘিরে আবর্তিত হয়। এখানে প্রকৃতি, প্রাণী বা প্রযুক্তিকে প্রায়ই মানুষের প্রয়োজনের সহায়ক বা পরিবেশগত উপাদান হিসেবে দেখা হয়। তবে পোস্ট-স্পিশিজ সমাজতত্ত্ব এই ধারণাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে। এটি যুক্তি দেয় যে, মানুষের জৈবিক সীমাবদ্ধতাগুলো প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে অতিক্রম করা সম্ভব হচ্ছে। কৃত্রিম অঙ্গ, জিন সম্পাদনা, মস্তিষ্ক-কম্পিউটার ইন্টারফেস এবং বায়োহ্যাকিংয়ের মতো প্রযুক্তিগুলো মানুষের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে।
এর ফলস্বরূপ, মানবজাতির বিবর্তন এখন কেবল জৈবিক প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং প্রযুক্তিগত নির্বাচনের উপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeats (CRISPR) প্রযুক্তির সাহায্যে জেনেটিক রোগ প্রতিরোধ করা, এক্সোস্কেলেটন স্যুট ব্যবহার করে শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি করা, কিংবা মস্তিষ্কে সরাসরি চিপ স্থাপন করে স্মৃতিশক্তি বা চিন্তাভাবনার গতি বাড়িয়ে দেওয়া—এসবই মানুষের স্বাভাবিক বিবর্তনের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
পোস্ট-স্পিশিজ সমাজতত্ত্ব প্রযুক্তিকে শুধু একটি সরঞ্জাম হিসেবে দেখে না, যা মানুষ তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করে। বরং এটি মানুষ এবং প্রযুক্তির মধ্যে একটি ‘গভীর ও পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া’ বা সম্পর্ক হিসেবে দেখে। এর অর্থ হলো, প্রযুক্তি শুধু আমাদের জীবনকে সহজ করে না, এটি আমাদের চিন্তাভাবনা, আচরণ এবং এমনকি আমাদের নিজেদের সম্পর্কে ধারণাকেও পরিবর্তন করে। যেমন, যখন আমরা স্মার্টফোন ব্যবহার করি, তখন এটি কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়; এটি আমাদের স্মৃতিশক্তি, মনোযোগের ক্ষমতা ও সামাজিক সম্পর্ককেও প্রভাবিত করে। এই মিথস্ক্রিয়ার কারণে মানব-অস্তিত্বের চিরাচরিত ধারণাটি বদলে যাচ্ছে।
ঐতিহ্যগতভাবে মানুষ নিজেদের পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে। আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি ও দর্শন—সবকিছুই মানুষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু পোস্ট-স্পিশিজ সমাজতত্ত্ব বলছে, নতুন বিশ্বে মানুষ আর সেই একক, ‘কেন্দ্রীয় চরিত্র’ নয়। এটি একটি সমন্বিত ব্যবস্থার অংশ হয়ে উঠেছে। এখানে মানুষ, প্রযুক্তি, পরিবেশ ও অন্যান্য জীব একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত।
উদাহরণস্বরূপ, জলবায়ু পরিবর্তন শুধু প্রাকৃতিক ঘটনা নয়; এটি মানব প্রযুক্তি ও কার্যকলাপের একটি ফল। একইভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো প্রযুক্তিগুলো মানুষের জীবনকে এমনভাবে প্রভাবিত করছে, যা আমাদের পরিবেশ এবং অন্যান্য জীবের জীবনকেও প্রভাবিত করছে। তাই এই নতুন প্রেক্ষাপটে আমাদের নিজেদের একটি ‘সমন্বিত সত্তা’ হিসেবে দেখা উচিত, যেখানে আমরা এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না, বরং প্রযুক্তি এবং পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে বিকশিত হচ্ছি।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যেখানে ডিজিটাল বিভাজন এখনও একটি বাস্তবতা, সেখানে পোস্ট-স্পিশিজ সমাজতত্ত্ব প্রথমে অনেকটা বিমূর্ত বা দুরূহ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যাবে, প্রযুক্তিগত অনুপ্রবেশ এবং সামাজিক রূপান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশও এই বৈশ্বিক আলোচনার অংশ হয়ে উঠছে। দেশের বিভিন্ন খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, যেমন ডিজিটাল শিক্ষা, টেলিমেডিসিন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রশাসন, এমনকি কৃষি খাতেও ড্রোন ও রোবোটিকসের ব্যবহার। এসবই সমাজে মানুষের ঐতিহ্যগত ভূমিকার ধারা পাল্টে দিচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলো কেবল উন্নত দেশগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয়ও এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
এই পোস্ট-স্পিশিজ ধারণাটি শুরুতে হয়তো কিছুটা তাত্ত্বিক মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এর প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দ্রুত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। দেশের বিভিন্ন খাতে প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তার এই পরিবর্তনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
১. কৃষি: রোবটচালিত উৎপাদন ও সামাজিক প্রভাব: বাংলাদেশের কৃষি খাত, যেখানে একসময় মানুষের কায়িক শ্রম ছিল প্রধান, সেখানে এখন প্রযুক্তি ধীরে ধীরে সেই জায়গা নিচ্ছে। ইতোমধ্যে ড্রোননির্ভর ফসল পর্যবেক্ষণ এবং কীটনাশক স্প্রে করার মতো প্রোগ্রাম চালু হয়েছে। এমনকি পরীক্ষামূলকভাবে রোবোটিক হারভেস্টারের ব্যবহার শুরু হয়েছে, যা মানুষের চেয়ে দ্রুত এবং কম খরচে ফসল কাটতে সক্ষম। এই পরিবর্তনগুলো গুরুত্বপূর্ণ সমাজতাত্ত্বিক প্রশ্ন তৈরি করে, যখন রোবট দিয়ে ফসল কাটা হবে, তখন ভূমিহীন কৃষকদের শ্রমশক্তির কী হবে? তারা কি প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পাবে, নাকি এর ফলে গ্রামীণ বেকারত্ব আরও বাড়বে? এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তন গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে, যদি নীতিনির্ধারকরা সময়মতো এর সমাধান না করেন। ধনী কৃষকরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আরও ধনী হবেন, আর প্রান্তিক কৃষকরা তাদের জীবিকা হারাবেন।
২. শহর ও শ্রমের ভবিষ্যৎ: মেগাসিটি ঢাকার মতো শহরে পোস্ট-স্পিশিজ বাস্তবতা আরও প্রকট। স্মার্ট সিটি পরিকল্পনা, স্বয়ংক্রিয় ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা এবং এআই-চালিত নজরদারি ব্যবস্থা শহুরে জীবনের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন করছে। এটি শহুরে দরিদ্র, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক এবং অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে?
৩. স্বাস্থ্য: এআইভিত্তিক রোগ নির্ণয় ও স্বাস্থ্যবৈষম্য: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতেও এআই-এর প্রভাব বাড়ছে। ঢাকার কিছু বেসরকারি হাসপাতাল ক্যানসার শনাক্তকরণের জন্য এআইচালিত ইমেজ স্ক্যানিং সফটওয়্যার ব্যবহার করছে, যার নির্ভুলতা প্রায় ৯৫ শতাংশ। গ্রামীণ এলাকায় টেলিমেডিসিন প্ল্যাটফর্মগুলো এআই-সহায়ক চ্যাটবট ব্যবহার করে রোগীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরামর্শ দিচ্ছে। এই অগ্রগতিগুলো আমাদের প্রচলিত ডাক্তার-রোগীর সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। যখন রোগ নির্ণয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত একটি মেশিন নেয়, তখন মানুষ ও প্রযুক্তির মধ্যেকার আস্থার সম্পর্ক কেমন হবে? প্রযুক্তি কি সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছাবে, নাকি শহরের সুবিধাভোগী এবং গ্রামীণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্য বৈষম্য আরও বাড়িয়ে তুলবে? স্বাস্থ্যসেবা যদি শুধু প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তবে মানবিক স্পর্শ এবং রোগ-যন্ত্রণার প্রতি সহানুভূতি কি হারিয়ে যাবে?
৪. পোশাকশিল্প: বাংলাদেশের পোশাকশিল্প, যা দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি, সেখানেও অটোমেশন একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। রোবট যখন সেলাই বা প্যাকেজিংয়ের কাজ করবে, তখন লাখ লাখ শ্রমিকের ভবিষ্যৎ কী হবে? এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তন কর্মসংস্থান, মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় কী ধরনের পরিবর্তন আনবে, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এই পরিবর্তনটি বিশেষত নারী শ্রমিকদের জন্য উদ্বেগজনক, কারণ পোশাকশিল্পের একটি বড় অংশ নারী শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল। এই পরিস্থিতিতে তাদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা কি বিপন্ন হবে, নাকি এই প্রযুক্তি নতুন ধরনের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করবে, যার জন্য নতুন দক্ষতা প্রয়োজন? পোশাকশিল্পে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে যে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কাজ হারাবেন, তাদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং পুনর্বাসনের জন্য কী ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে—এই প্রশ্নগুলো এখন থেকেই আলোচনা করা প্রয়োজন।
৫. শিক্ষা: এআই–সহায়ক শেখার পদ্ধতি ও মানবিক সম্পর্ক: শিক্ষা খাতেও একই ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২৩’ অনুযায়ী, এআই-চালিত টিউটরিং প্ল্যাটফর্ম, ভাচুয়াল ল্যাব এবং ডিজিটাল কনটেন্ট ধীরে ধীরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্ত হচ্ছে। এই প্রযুক্তিগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ক এবং শিক্ষকের ভূমিকা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তৈরি করছে। প্রযুক্তি কি শিক্ষকের বিকল্প হয়ে উঠবে, নাকি তাদের কেবল সহায়ক হিসেবে কাজ করবে? গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা যেখানে ইন্টারনেট সংযোগের অভাবে ডিজিটাল শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সেখানে শহর ও গ্রামের মধ্যে শিক্ষার সুযোগের পার্থক্য আরও বাড়তে পারে।
পোস্ট-স্পিশিজ বাস্তবতা শুধু প্রযুক্তিগত বা অর্থনৈতিক পরিবর্তন নিয়েই আসে না, বরং এটি আমাদের সামনে গভীর নৈতিক এবং দার্শনিক প্রশ্নও তুলে ধরে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে গবাদিপশুর উৎপাদনক্ষমতা বাড়াই, তাহলে কি আমরা প্রাণীর প্রাকৃতিক জীবনধারার নৈতিক সীমা অতিক্রম করছি? ল্যাব-উৎপাদিত মাংস যদি বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে জনপ্রিয় হয়, তাহলে কি তা ইসলামিক হালাল মানদণ্ড মেনে চলবে?
সবচেয়ে জটিল প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি হলো, জীবন-মৃত্যুর মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কি কোনো মেশিনের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায়? যখন একজন এআইচালিত চিকিৎসক একজন রোগীকে কৃত্রিম লাইফ সাপোর্ট থেকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেই নৈতিক দায় কার? প্রযুক্তি ও মানুষের সম্পর্ক যখন এত গভীর হয়ে উঠবে, তখন মানবিকতা এবং নৈতিকতার নতুন সংজ্ঞা তৈরি করা অপরিহার্য হয়ে পড়বে। আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে প্রযুক্তির এই নতুন বাস্তবতাকে কীভাবে মেলানো যায়, তা নিয়ে এখনই আলোচনা শুরু করা জরুরি।
প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের এই সময়ে বাংলাদেশ যদি সম্পূর্ণভাবে বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে একটি বড় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে ডিজিটাল নব্য-উপনিবেশবাদ। বিদেশি ক্লাউড সার্ভারে স্বাস্থ্য তথ্য সংরক্ষণ করা হলে তা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। একইভাবে এআইভিত্তিক কৃষি অ্যাপ যদি বিদেশি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়, তাহলে তা স্থানীয় কৃষিপণ্য এবং বাজারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
এটি এমন একটি পরিস্থিতি, যেখানে প্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের জন্য জরুরি হলো নিজস্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তৈরি করা এবং ডেটা সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার জন্য কঠোর নীতি প্রণয়ন করা। দেশের ভেতরের তথ্য যেন দেশের বাইরে চলে না যায় এবং বাইরের কোনো শক্তি যেন আমাদের জনগনের ওপর প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মানবিক উন্নয়নের জন্য এই পোস্ট-স্পিশিজ সমাজতত্ত্বের চ্যালেঞ্জগুলোকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা অত্যাবশ্যক। এর জন্য প্রয়োজন দূরদর্শী নীতি এবং শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন।
১. শিক্ষা ও গবেষণা: দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে টেকনো-সোশ্যাল স্টাডিজ বা বায়োইথিক্সের মতো নতুন বিষয় চালু করা যেতে পারে, যা শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ও সমাজের মধ্যকার জটিল সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে শেখাবে।
২. নীতি প্রণয়ন: জাতীয় ডেটা নীতি প্রণয়ন করা জরুরি, যা ডেটা সার্বভৌমত্বকে নিশ্চিত করবে এবং বিদেশি প্রযুক্তি নির্ভরতা কমাবে। এআই-এর নৈতিক ব্যবহারের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরি করা উচিত, যা দেশের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে।
৩. শ্রমশক্তি রূপান্তর: পোশাকশিল্প বা কৃষির মতো খাতে যে শ্রমিকরা চাকরি হারাচ্ছেন, তাদের জন্য নতুন প্রযুক্তিভিত্তিক কাজের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা প্রয়োজন। এই রূপান্তর যেন সুষম হয় এবং কেউ যেন পিছিয়ে না পড়ে, তা নিশ্চিত করা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
৪. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রযুক্তির সম্ভাব্য ঝুঁকি ও সুবিধা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, যাতে তারা এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে এবং প্রযুক্তির শিকার না হয়।
পোস্ট-স্পিশিজ সমাজতত্ত্ব আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রযুক্তি কেবল উন্নয়নের একটি হাতিয়ার নয়, বরং এটি আমাদের অস্তিত্বের কাঠামোকে পরিবর্তন করছে। বাংলাদেশের সামনে এখন দুটি পথ খোলা আছে—হয় আমরা প্রযুক্তির নিষ্ক্রিয় গ্রহীতা হয়ে এর সামাজিক পরিণতিগুলো মেনে নেব, অথবা আমরা প্রযুক্তির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশীদার হয়ে আমাদের নিজস্ব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একে রূপ দেব। এটি কেবল একটি তাত্ত্বিক বিতর্ক নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মানবিক উন্নয়নের নীতি, নৈতিকতা এবং বাস্তবায়নের জন্য একটি অপরিহার্য দিকনির্দেশনা। প্রযুক্তির এই নতুন যুগে, আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে মানবীয় মূল্যবোধ ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখা, যেন আমরা শুধু উন্নত জীবন নয়, বরং আরও অর্থপূর্ণ ও মানবিক জীবন নিশ্চিত করতে পারি।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

Discussion about this post