নানা কারণে নতুন করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার আগ্রহ ফিরে পেয়েছেন অনেকেই। এতে শেয়ারের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। চাহিদা বৃদ্ধি বিবেচনায় নিয়ে নতুন শেয়ারের জোগান বাড়ানো না হলে বিদ্যমান শেয়ারের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি নতুন করে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
সোমবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সঙ্গে অংশীজনের বৈঠকে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা এমন সতর্কতা ব্যক্ত করেছেন। এতে স্টক এক্সচেঞ্জ, সিডিবিএল, ব্রোকার, মার্চেন্ট ব্যাংক, সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানির প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বিশ্লেষকরা বলেছেন, বিনিয়োগকারীরা বাজারে ফিরছেন। তাদের এই আগ্রহ ধরে রাখতে হবে। পাশাপাশি অতীতের মতো বাজার যাতে অস্থিতিশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ না হয়ে পড়ে, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। আশুগঞ্জ পাওয়ার এবং এসেনসিয়াল ড্রাগসের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগ্রহ আছে। এখন দরকার সরকারের ‘সবুজ সংকেত’। এর বাইরে সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি প্রতিষ্ঠান সিডিবিএলের মতো কোম্পানির আইপিও দ্রুত আনা সম্ভব। আমরা মনে করি, ঝুঁকি হ্রাসের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো নতুন শেয়ারের জোগান বাড়ানো। বর্তমান সরকার থাকতেই সরকারি কিছু ভালো কোম্পানির সঙ্গে বহুজাতিক এবং বেসরকারি খাতের বড় কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনতে হবে এছাড়া পুঁজিবাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিলকে অবিলম্বে ট্রাস্টে রূপান্তর করার কথা বিবেচনা করতে হবে। অন্যথায় রাজনৈতিক সরকারের সময় এ তহবিল ‘নয়-ছয়’ হওয়ার শঙ্কাও থাকে। স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল পুঁজিবাজারে জন্য স্টেকহোল্ডারদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান যদি স্টেকহোল্ডারদের কার্যক্রম শক্তভাবে মনিটরিং করতে পারে, তাহলে বাজারে কখনও অস্বাভাবিক ও অস্থির আচরণ দেখা যাবে না।
দেশের পুঁজিবাজারের যাত্রা ছয় দশকের বেশি। কিন্তু অপরাপর দেশ কিংবা আমাদের অর্থনীতির অগ্রগতির সঙ্গেও তাল মিলিয়ে দেশের পুঁজিবাজার এগোতে পারেনি। আমাদের জিডিপির আকার কম-বেশি ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। অথচ এখনও আমাদের পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেশি, ৮০ শতাংশের ওপরে। বিশেষজ্ঞরা একে বড় কাঠামোগত দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করছেন।
ইতোমধ্যে দুই দফায় পুঁজিবাজারে বড় ধরনের দরপতনে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের স্বার্থের সুরক্ষা দিতে পারেনি। ফলে পুঁজিবাজারকে ঘিরে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ছিল অনেক কম। বর্তমানে ধীরে ধীরে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে। অন্যদিকে দেশের বাজারে পণ্যবৈচিত্র্যের বড় ঘাটতিও রয়েছে। বাজার পর্যালোচনা অনুসারে দেখা যাচ্ছে, জিডিপিতে পুঁজিবাজারের অবদান ভারতে ৬২ দশমিক ৭৫ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৮৯ দশমিক ২৯, হংকংয়ে ১ হাজার ৩১১ দশমিক ১৪ ও চীনে ৩৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। এটা রাতারাতি অর্জন সম্ভব হয়নি। এর জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। পুঁজিবাজারের কাঠামোগত সংস্কার করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। দেশি-বিদেশি ভালো ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তথ্যগত স্বচ্ছতা ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জগুলো অটোমেশন ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে। অন্যায্য কারসাজি রোধে কঠোর আইন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সার্বক্ষণিক নজরদারি নিশ্চিত করা হয়েছে। একটি পরিপূরক সেকেন্ডারি মার্কেটও গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে উল্লিখিত দেশগুলোর কর্মপ্রক্রিয়া ও অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য অনুসরণীয়।
পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা আনতে অডিটর বা নিরীক্ষকদের কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিএসইসির সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। বিশেষ করে দক্ষ জনবলের সন্নিবেশ ঘটানো, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, আইনের সংস্কার ও সাংগঠনিক কাঠামোগত রূপান্তরের মাধ্যমে উন্নয়নশীল বিশ্বের সফল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার আদলে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। প্রাথমিক শেয়ারের মূল্য নির্ধারণে কার্যকর নিয়মাবলি অনুসরণে অডিট ফার্ম, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির ভূমিকা নির্ধারণ এবং তা তদারকির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা রাখতে নিয়মকানুনের সংস্কার প্রয়োজন। স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও বাড়িয়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে সেকেন্ডারি বাজারকেও শক্তিশালী করতে হবে। সংস্কারের পথে কোনো দুষ্টু বা অনভিজ্ঞ অথচ আপাত শক্তিশালী পক্ষ যাতে প্রভাব বিস্তার না করতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আইন ও নীতিকাঠামোয় কিছুটা সংস্কার আনা হয়েছে। এতে অবশ্য খুব কমই সুফল মিলেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসছেন না, বরং আগের কিছু বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে চলে যাওয়ার খবর মিলছে। এদের ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিতে হবে। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন খাতের ভালো ভালো কোম্পানিকে বাজারে কীভাবে তালিকাভুক্ত করা যায়, তার উপায় সন্ধান করতে হবে। অন্যদিকে শুধু বিনিয়োগকারীদের উদ্বুদ্ধ করলেই হবে না, বাজারে ভালো শেয়ারের জোগানও নিশ্চিত করতে হবে। অন্যান্য দেশে পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডের অবদান ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। এখানে এর আকার ছোট। সর্বোপরি বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ দক্ষতা বাড়াতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গৎবাঁধা রচনার মতো শোনালেও নির্মম সত্য হচ্ছে, দেশের অর্থনীতির ভিত্তি টেকসই ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিতে দেশে একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার প্রয়োজন। উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া, মানুষের আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি প্রভৃতি লক্ষ্য অর্জন করতে হলেও স্থিতিশীল পুঁজিবাজারের বিকল্প নেই।

Discussion about this post