মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর : যশোর জেলায় কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণে চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কৃষক ও জনজীবন। টানা বৃষ্টিতে জেলার চুড়ামনকাটি, হৈবতপুর, কাশিমপুর, চৌগাছা, সিংহঝুলি, ফুলসারা, দেয়াড়া ও পাশাপোলসহ বিস্তীর্ণ এলাকার মাঠঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। এর প্রভাবে সবজিসহ নানা ফসলের ক্ষেতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে যশোরে ৬০ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে ধান, সবজি, পাট ও অন্যান্য ফসলের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৩ হাজার ১৯১ হেক্টর জমির ফসল প্রবল বৃষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছে। বিশেষ করে সবজি, রোপা আউশ, রোপা আমনের বীজতলা, পাট ও মরিচের ক্ষেতগুলো বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে।
যশোরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সবজি উৎপাদন অঞ্চল হিসেবে পরিচিত চুড়ামনকাটি, হৈবতপুর ও কাশিমপুর ইউনিয়ন। এসব এলাকায় মাঠের পর মাঠ জুড়ে পটোল, বরবটি, পুঁইশাক, উচ্ছে, ঢ্যাঁড়শ, বেগুন, আগাম পাতাকপি ও কচুরমুখির আবাদ করছিলেন কৃষকরা। কেউ কেউ শীতকালীন সবজির আগাম চারা প্রস্তুতের শেষ ধাপে ছিলেন। কিন্তু প্রবল বর্ষণে সেই সবজি ক্ষেতসহ বীজতলাও পানির নিচে চলে গেছে।
জানা গেছে, সবজি বাঁচাতে কৃষকরা বৃষ্টির মধ্যেই জমির পানি সেচে ফেলার চেষ্টা করছেন। তবে অনেকে জানিয়েছেন, পানি নামার আগেই অধিকাংশ গাছ পচে মারা যাবে।
চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের পটোলচাষি তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার পটোল ক্ষেত পুরোপুরি পানির নিচে। কিছুই বাঁচবে না এবার। আমার স্বপ্নও ভেসে গেল।’
একই এলাকার বরবটি চাষি দেলোয়ার গাজী জানান, ‘গাছে ফুল এলেও ভারী বৃষ্টিতে সব ঝরে গেছে। ফলন তো হবেই না, বরং গাছগুলোও মরতে বসেছে।’
সবজির পাশাপাশি চারা উৎপাদনে যুক্ত কৃষকরাও পড়েছেন মহা দুর্বিপাকে। আব্দুলপুর গ্রামের চাষি টিটো বলেন, ‘চারা কিছুটা বাঁচলেও তা আর বিক্রি করা যাবে না। এর গুণমান নেই।’
এদিকে চৌগাছা উপজেলার সিংহঝুলি ও ফুলসারা ইউনিয়নের বলিদাপাড়া বিল, স্বরূপদাহ ইউনিয়নের বাওড়পাড়সহ এড়লের বিস্তীর্ণ বিল এলাকাও তলিয়ে গেছে। এসব এলাকায় রোপা আউশ ও আমন ধানের আবাদ শুরু হয়েছিল। এরই মধ্যে আমনের বীজতলার অধিকাংশই পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
চাষিরা বলছেন, এখনই ধান রোপণের উপযুক্ত সময়। কিন্তু এমন ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে রোপণ সম্ভব নাও হতে পারে। যদিও অনেক কৃষক নতুন করে বীজ সংগ্রহ করে বিকল্প বীজতলা তৈরির চেষ্টা করছেন।
কৃষিবিদ ইউসুফ আলী জানিয়েছেন, বর্ষার পর হঠাৎ রোদ উঠলে জমে থাকা পানির নিচে তাপমাত্রা বাড়ে, ফলে গাছের গোড়ায় পচন ধরে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোশারফ হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই মাঠ পর্যায়ে তথ্য নিচ্ছি। কৃষক যেন এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে, সে লক্ষ্যে সম্ভাব্য সকল সহায়তা ও পরামর্শ দেয়া হবে।’
এদিকে বৃষ্টিতে চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শ্রম না পেয়ে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষরা। তাদের অনেকের সংসারে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যশোর বিমানবন্দর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সোমবার একদিনেই যশোরে ১৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ ছাড়া রোববার ৬৭ ও মঙ্গলবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী আরও চার দিন একই ধরনের প্রবল বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
স্থানীয় কৃষক ও সচেতন মহলের দাবি, অবিলম্বে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জরুরি প্রণোদনা ও সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করা হোক। অন্যথায় দেশের অন্যতম এই সবজি উৎপাদন অঞ্চলের কৃষকরা বড় ধরনের সংকটে পড়বেন।
একইসঙ্গে বাজারে হতে পারে সবজির তীব্র সংকট এবং নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের ওপর।

Discussion about this post