নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : দেশের পুঁজিবাজারের অন্যতম প্রধান অংশীজন ব্রোকারেজ হাউসগুলো একের পর এক ব্যবসা ছোট করে আনছে। লেনদেন খরা, খরচ নিয়ন্ত্রণ এবং সনদ নবায়ন জটিলতার কারণে চলতি বছরে অনেক অফিসেই তালা ঝুলেছে। কেউ অফিস সংস্কারের কথা জানালেও বাস্তবে লেনদেন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের মোট ১১৭টি অফিসÑমূল কার্যালয়সহ শাখা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি হাউসের প্রধান কার্যালয়ও অচলাবস্থায় রয়েছে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নিবন্ধিত ট্রেক সনদ নিয়ে বাজারে ব্রোকারেজ হাউসগুলো কার্যক্রম চালায়। বর্তমানে ট্রেক হোল্ডার ৩০৭টি হলেও বিভিন্ন কারণে স্থগিত ৫টি ছাড়া সচল রয়েছে ৩০২ প্রতিষ্ঠান। তাদের মূল ও শাখা অফিস মিলিয়ে সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৫০০টি। এর মধ্যে ১১৭টি এখন বন্ধ।
সাদ সিকিউরিটিজের মিরপুর ও নারায়ণগঞ্জ শাখা বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসাইন বলেন, ‘বাজারের বর্তমান অবস্থা এমন যে শুধু শাখা নয়, সব অফিসেই তালা ঝুলিয়ে দেয়া উচিত। দেড় বছর ধরে নতুন আইপিও নেই, বিনিয়োগকারী আসবে কীভাবে? বিনিয়োগকারী না থাকলে ব্যবসাও টিকবে না।’
ইউনাইটেড সিকিউরিটিজ জানায়, তাদের প্রধান কার্যালয়ে ‘সংস্কার কাজ’ চলায় আপাতত লেনদেন বন্ধ। ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. সাব্বির হুসাইন বলেন, ‘অফিসটি একই ভবনের ৮ তলা থেকে ১১ তলায় সরানো হচ্ছে। সাজসজ্জার কাজ শেষ হলে লেনদেন আবার শুরু হবে।’
শার্প সিকিউরিটিজও একটি শাখা বন্ধ করেছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা অনলাইন সেবায় জোর দিচ্ছি। পাশাপাশি কম লেনদেনে খরচ বাঁচাতে শাখা বন্ধ রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে চাহিদা বাড়লে পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নেব।’
সনদ নবায়ন জটিলতায় একসময় বাজারের বড় খেলোয়াড় বেক্সিমকো সিকিউরিটিজ লিমিটেডের লেনদেনও বন্ধ। এই হাউসের বিও হিসাবধারী মাসুদ আহমেদের ১৯ লাখ টাকার বিনিয়োগের বাজারমূল্য বর্তমানে নেমে এসেছে ৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকায়। লোকসান সত্ত্বেও একটি শেয়ার বিক্রি করতে চাইলে জানতে পারেন লেনদেন বন্ধ। মাসুদ আহমেদ বলেন, ‘টাকা দরকার ছিল, লোকসান মেনেই বিক্রি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হাউস বন্ধ, বিক্রি করতে পারলাম না। বিপদের সময়ে টাকা তুলতে না পারলে এমন বিনিয়োগ দিয়ে কী হবে? বড়রা লুটপাট করে, দায় নিতে হয় আমাদের মতো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের।’
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, ব্রোকারেজ হাউসগুলোর মূল অফিস ও শাখা অফিসের অধিকাংশই রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রাম অঞ্চলে। বাজারে লেনদেন কম হওয়া, সনদ নবায়ন না হওয়া এবং অফিস সংস্কারের কথা জানিয়ে বন্ধ রাখা হয়েছে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর প্রধান কার্যালয়সহ ১১৭টি শাখা অফিস। এর মধ্যে বিকল্প লেনদেন অফিস না থাকায় কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসের হিসাবধারী এখন শেয়ার লেনদেনও করতে পারছে না।
জামাল উদ্দীন নামের এক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী শেয়ার বিজকে বলেন, পুঁজিবাজারে লেনদেন কমে যাওয়ায় একের পর এক ব্রোকারেজ হাউস ছোট হয়ে আসছে। অনেক প্রতিষ্ঠান শাখা-অফিস বন্ধ করে দিচ্ছে, আবার কেউ কেউ পুরোপুরি ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে।
ওই বিনিয়োগকারী বলেন, ‘ট্রেড যদি এমন কমে যায়, ব্রোকারেজ হাউসগুলো টিকবে কীভাবে? প্রতিদিনই দেখি কোনো না কোনো অফিস বন্ধ হচ্ছে। আগে যেখানে বাজারে প্রাণচাঞ্চল্য ছিল, এখন সেখানে নীরবতা।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা বাজারে আস্থা হারালে লেনদেন বাড়বে না। আর লেনদেন না বাড়লে ব্রোকারেজ হাউসগুলো তো ক্ষতির মুখে পড়বেই। বাজার সচল রাখতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।’
উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর তিন দিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হতে যাচ্ছেÑএমন খবরে পুঁজিবাজারের সূচক বেড়েছিল। কিন্তু সরকার গঠনের পর থেকে আবার তা কমতে থাকে।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নিজে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। তারা বাজার বিশ্লেষণ করে ঠিক পদক্ষেপও নেয়নি। আস্থার সংকটে ভালো শেয়ারেরও তাই দর কমছে। সরকার পতন, নতুন সরকার গঠন এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় পুঁজিবাজারে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। এ ছাড়া পুঁজিবাজারে কারসাজির সঙ্গে জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে বর্তমান কমিশন ব্যবস্থা নেয়ায় নতুন করে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে না। আগের বিনিয়োগকারীরাও ভয়ে সরে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
২০১৬ সালের ২০ জুন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৩২ লাখ ৭৬৬ জন থাকলেও চলতি বছরের মে মাসে এই সংখ্যা ১৬ লাখ ৯০ হাজার ২২৭ জনে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দিন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী ছিল ১৬ লাখ ৬৮ হাজার ৮৯৫ জন।
চলতি বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রতিনিয়তই কমছে সূচক। বাজারে ভালো শেয়ার থাকলেও সেগুলোর দরও কমছে। পাশাপাশি আছে আরও কিছু বড় সংকট, যেসবের কারণে পুঁজিবাজারে ছড়িয়ে পড়ছে আস্থার সংকট।
দীর্ঘমেয়াদি মন্দা, আস্থার সংকট এবং ভালো শেয়ারের অভাবে গত ৯ মাসেই পুঁজিবাজার ছেড়েছেন বা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন ৬২ হাজারের বেশি বিনিয়োগকারী। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) সর্বশেষ তথ্যে এ চিত্রই উঠে এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকঋণের সুদহার এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এখন পুঁজিবাজারের ঝুঁকি এড়িয়ে সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিটের মতো নিরাপদ বিনিয়োগে ঝুঁকছেন।
প্রিন্ট করুন











Discussion about this post