শাকিল আহমেদ, নোয়াখালী : মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে নোয়াখালীতে প্রবল বৃষ্টিতে জেলার বেশির ভাগ সড়ক ও অলিগলির রাস্তাঘাট ডুবেছে। একদিকে ভারী বর্ষণ, অন্যদিকে পানি আটকে থেকে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। এর মধ্যে ফেনীর মুহুরী নদীর পানি বাড়তে থাকায় নোয়াখালীতে ফের বন্যার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। গতকাল বুধবার দুপুরে জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় নোয়াখালীতে ২২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে আরও ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এই অবস্থায় নদীবন্দরে ১ নম্বর ও সমুদ্র বন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এদিকে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে উপকূলীয় জেলা নোয়াখালীর চারটি উপজেলার মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী গতকাল বুধবার ও পরদিন বৃহস্পতিবারের পরীক্ষাগুলো স্থগিত থাকবে। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নুর উদ্দিন জাহাঙ্গীর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, দুই দিন ধরে নোয়াখালীতে টানা বৃষ্টির ফলে সদর, সুবর্ণচর, কবিরহাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে। বিদ্যালয়ে যাতায়াতের রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওই সব উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা তার কাছে বুধবার ও বৃহস্পতিবার মাধ্যমিক পর্যায়ের সব স্কুল ও মাদরাসার চলমান অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত রাখার নির্দেশনা চেয়েছেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আগামী দুই দিনের পরীক্ষা স্থগিত রাখতে বলেছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে জেলায় ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ১৭ সেন্টিমিটার। তবে পনি এখনও বিপৎসীমার এক সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে। টানা বৃষ্টিতে নোয়াখালীর সদর, কোম্পানীগঞ্জ, কবিরহাট ও সুবর্ণচরে বেশি জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
অপরদিকে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে জেলার অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এরই মধ্যে অনেকটা বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের বসতঘরে পনি ঢুকেছে।
জলাবদ্ধতা সবচেয়ে বেশি দেখা দিয়েছে জেলা শহর মাইজদীতে। এখানে বিভিন্ন সড়ক ও পাড়া-মহল্লা পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নোয়াখালী পৌর শহরের স্টেডিয়াম পাড়া, জেলখানা সড়ক এলাকা, ফকিরপুর, হরিনারায়ণপুর, লক্ষ্মীনারায়ণপুর, হাউজিংসহ বেশিরভাগ এলাকার সড়কগুলোয় হাঁটুর কাছাকাছি পানি উঠে গেছে। এ ছাড়া এসব এলাকার নিচতলা ও কাঁচা ঘরগুলোয় পানি ঢুকেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন বাসিন্দারা। চলতি বর্ষায় শহরের বেশিরভাগ সড়কে খানাখন্দ তৈরি হওয়ায় সড়কগুলো মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাব এবং পানি নিষ্কাশনের নালা ও জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় শহরবাসীর এ দুর্ভোগ। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন অনেকে। হালকা বৃষ্টিতেই নোয়াখালী পৌরসভা এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এদিকে টানা বৃষ্টিতে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভা এলাকার করালিয়া, মওদুদ স্কুল, কলেজ গেট, হাসপাতাল গেটসহ অনেক এলাকার রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে গেছে। অপরদিকে বেগমগঞ্জ, কবিরহাট, সুবর্ণচর ও সেনবাগ উপজেলায় মুষলধারে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় এলাকাবাসীদের জলাবদ্ধতা দূর করতে সচেতন হওয়া জরুরি বলে মনে করে সচেতন মহল।
নোয়াখালী জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ জানায়, জেলায় মোট ৪৬৬টি আশ্রয়কেন্দ প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যেখানে মোট তিন লাখ ৭২ হাজার ৮০০ জন মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হবে। এর মধ্যে বেগমগঞ্জ উপজেলায় একটি আশ্রয়কেন্দে র ধারণ ক্ষমতা ৮০০ জন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ৪৭ টি আশ্রয়কেন্দে ৩৭ হাজার ৬০০ জন, কবিরহাট উপজেলায় ১৩টি আশ্রয়কেন্দে ১০ হাজার ৪০০ জন, নোয়াখালী সদর উপজেলায় ৩৬টি আশ্রয়কেন্দে ২৮ হাজার ৮০০ জন, সুবর্ণচর উপজেলায় ১২৭টি আশ্রয়কেন্দে এক লাখ ১৬ হাজার জন এবং হাতিয়া উপজেলায় ২৪২টি আশ্রয়কেন্দে এক লাখ ৯৩ হাজার ৬০০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে।
মজুত ত্রাণ সামগ্রীর মধ্যে ৫০০ মেট্রিক টন চাল, নগদ অর্থ ১৮ লাখ টাকা এবং শুকনো খাবার রয়েছে ২৭৬০ প্যাকেট।
দুর্যোগকালীন মেডিকেল চিকিৎসার জন্য ১০১টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে, যার মধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে ৯২টি এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৯টি টিম কাজ করবে।
এদিকে, ফেনীতে ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজানের পানিতে পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। দুই উপজেলার ২০টি স্থানে ভাঙনে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ। এতে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। দুর্গতদের অভিযোগ, বাঁধ ভাঙার ২৪ ঘণ্টা পার হলেও এখনো প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা মেলেনি।
পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মুহুরী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পরশুরাম উপজেলার জঙ্গলঘোনায় দুইটি, অলকায় তিনটি, শালধর এলাকায় একটি, ফুলগাজী উপজেলার উত্তর শ্রীপুর এলাকায় একটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সিলোনিয়া নদীর পরশুরামের গদানগর এলাকায় একটি ও ফুলগাজীর দেড়পড়া এলাকার দুইটি স্থানে ভেঙেছে। এছাড়া কহুয়া নদীর পরশুরাম উপজেলার সাতকুচিয়ায় দুইটি, বেড়াবাড়িয়ায় একটি ও ফুলগাজী উপজেলার দৌলতপুর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের একটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার (৮ জুলাই) বিকেল থেকে এসব স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। তীব্র স্রোতে পানি প্রবেশ করে। এখনো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
ফুলগাজীর মুন্সিরহাট গাইনবাড়ি এলাকার বাসিন্দা আছমা আক্তার বলেন, রাত থেকে ঘরে পানি ঢুকতে শুরু করে। কিছু জিনিসপত্র ওপরে তুলেছি। এখনো প্রশাসনের কাউকে এলাকায় আসতে দেখিনি। খাবার ও নিরাপদ পানি সংকটে পরিবার নিয়ে অসহনীয় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। গেল বছরের ক্ষতি কাটিয়ে উঠার আগেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকদের দায়সারা কাজের কারণে আবারও পানিতে ডুবতে হয়েছে।
ফুলগাজী উত্তর শ্রীপুর নাপিতকোনা এলাকার বাসিন্দা জাহানারা বেগম বলেন, গতকাল বিকেলে স্থানীয়দের নিয়ে অনেক চেষ্টা করেও বাঁধ রক্ষা করা যায়নি। পানি ঢুকে বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে। পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিলেও খাবার ও পানির জন্য বেশি কষ্ট হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে সব ধরনের যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা আর এভাবে পানিতে ভাসতে চাই না, টেকসই বাঁধ চাই।
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহরিয়া ইসলাম বলেন, আমরা কিছু এলাকায় শুকনো খাবার, স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পাঠিয়েছি। যারা আশ্রয়কেন্দে এসেছে তাদের জন্য শুকনো খাবার ও রান্না করা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, জেলায় টানা তিন দিন ধরে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গতকাল বুধবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। গতকালের তুলনায় বৃষ্টিপাত কমেছে। আগামীকালও জেলাজুড়ে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানে বৃষ্টি বন্ধ থাকলে বাঁধে ভাঙনের শঙ্কা কমবে। এখন ভাঙন এলাকা দিয়ে পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় ৪০০ করে মোট ৮০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি দুর্গতদের মাঝে রান্না করা খাবার সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

Discussion about this post