প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম : ডলারের ঊর্ধ্বগতি ও চাহিদা সংকটে ধুঁকতে থাকা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন করে শুরু হলো ‘ট্যারিফ ঝড়’। যার আঘাতের শেষ স্থল হবে রান্নাঘর। এর মধ্যে এই ট্যারিফ ঝড়ে বাড়বে দ্রব্যমূল্য। প্রায় খাদের কিনারে রয়েছে দেশের অর্থনীতির প্রধান আয়ের খাত পোশাকশিল্প। এ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন ও দিশাহারা ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, একদিকে মার্কিন শুল্ক, তার সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরে সব ধরনের মাশুল বৃদ্ধি। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণাধীন বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি) কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ বৃদ্ধির ঘোষণা; যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হচ্ছে। তবে আইসিডি ট্যারিফ কার্যকর হবে ১ সেপ্টেম্বর থেকে। আর এই ট্যারিফ ঝড়ে স্থিমিত হয়ে পড়তে পারে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। যার প্রভাব সরাসরি দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর পড়বে। দিশাহারা হয়ে পড়বে গরিব মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ।
এরই মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের এ ঘোষণার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্র্যান্ডগুলো ক্রয়াদেশ বাতিল করছে বা স্থগিত রাখছে। অনেক ক্রেতা আবার এই বাড়তি শুল্কের বোঝা আমাদের কারখানাগুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে।
এই সংকট শুধু পোশাক কারখানার মালিকদের নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন, ব্যাংকিং, বিমা, পরিবহনসহ পুরো সরবরাহ ব্যবস্থা (সাপ্লাই চেইন) একযোগে ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। প্রতিটি কারখানা বন্ধ হওয়ার অর্থ শুধু উৎপাদন থেমে যাওয়া নয়, হাজার হাজার পরিবারের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়া।
বিজিএমইএর তথ্যমতে, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭৩৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। নতুন শুল্কহারে শুধু কর বাবদই গুনতে হবে ২০০ কোটি ডলারের বেশি। এই বিপুল অর্থ দিয়ে ভিয়েতনাম বা ভারতের মতো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব।
চট্টগ্রাম বন্দরেও ট্যারিফ বৃদ্ধির ঘোষণা: মার্কিন শুল্কের চাপে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। ঠিক তখনই ঘোষণা এলো চট্টগ্রাম বন্দরের সব ধরনের মাশুল বৃদ্ধির ঘোষণা; যা গড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ। ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হচ্ছে এই মাশুল আদায়। আর ঘোষণাকে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। তবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, প্রায় চার দশক পর অর্থাৎ ১৯৮৬ সালের পর এই প্রথম দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দর তাদের সব ধরনের সেবার মাশুল বাড়াতে চলেছে। যার গড় বৃদ্ধির হার প্রায় ৪০ শতাংশ। বন্দরের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এ পদক্ষেপ অপরিহার্য।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, ১৯৮৬ সালে নির্ধারিত ট্যারিফ কাঠামোটি এখন যেন জাদুঘরের নিদর্শন। গত ৩৮ বছরে বন্দরের পরিচালন ব্যয়, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা এবং কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বেড়েছে বহুগুণে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বন্দরের নিজস্ব কেনাকাটার খরচও আকাশচুম্বী। এই মাশুল বৃদ্ধি থেকে প্রাপ্ত অর্থ বন্দরের উন্নয়নে ব্যয় হবে। নতুন নতুন গ্যান্টিক্রেন সংযোজন, ইয়ার্ড সম্প্রসারণ এবং অটোমেশন করা হবে, যার চূড়ান্ত সুবিধা বন্দর ব্যবহারকারীরাই পাবেন।
ট্যারিফ বাড়ছে আইসিডিতেও: দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান সহায়ক খাত বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি)। মার্কিন শুল্ক ও চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন খাতে ট্যারিফ বৃদ্ধির পর কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ট্যারিফ বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন এ আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)।
সম্প্রতি এক বিজ্ঞপ্তিতে নতুন কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ নির্ধারণ এবং আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে এই ট্যারিফ কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে বিকডা। এতে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নতুন করে সংকট সৃষ্টি করবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে বিকডার এই ঘোষণা শিপিং লাইন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের কেউ মেনে নেবে না বলে জানিয়েছেন।
আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং শিপিং খাতের বিশ্লেষকরা বলেছেন, সময়টা খারাপ। দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সংবেদনশীল কঠিন সময় পার করছে। রপ্তানি আদেশ স্থগিত, বাতিল এবং হ্রাসের ঘটনা ঘটছে হরদম। বিশ্ববাজারে অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ বৃদ্ধি ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
তারা বলেন, নতুন চার্জ কাঠামো ঘোষণার পর থেকে দেশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোয় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষত তৈরি পোশাক শিল্প যারা ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ধাক্কা সামলে প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য রপ্তানি করে নিজেদের টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, তাদের জন্য এটি বড় সংকট সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

Discussion about this post